অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ২৪ ঘণ্টায় ১৭০ লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় তাদের যুদ্ধবিমান গাজা উপত্যকায় ১৭০টি ‘সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তুতে’ হামলা চালিয়েছে এবং এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তিনটি ডিভিশনের সৈন্য গাজা সিটি ও এর উত্তরাঞ্চলে স্থল অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এ সময় তারা কয়েকজন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে হত্যা এবং একটি অস্ত্র গুদাম ধ্বংসের দাবি করেছে। তবে এসব দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা হাজির করেনি।
বিশ্বনেতাদের আহ্বান উপেক্ষা করে গাজায় ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত রয়েছে। এতে নিহত হয়েছেন আরও ৮৫ জন। এর মধ্যে নুসেইরাত শরণার্থী ক্যাম্পে আল-আহলি স্টেডিয়ামে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুতদের ওপর হামলায় ১২ জন প্রাণ হারান। নিহতদের মধ্যে ছিলেন সাত নারী ও দুই শিশু।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা হামাসের দুই যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। তবে হতাহতের তথ্য তাদের তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এরই মধ্যে হামাসের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত শহরের কেন্দ্রে অগ্রসর হওয়া অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনীর ট্যাংক ও সৈন্যরা।
এখনো হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্ত করাই স্থল অভিযানের লক্ষ্য বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। একইসঙ্গে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীর ‘চূড়ান্ত পরাজয়’ নিশ্চিত করাও এই বাহিনীর লক্ষ্য বলে তারা জানিয়েছে।
গাজার সবচেয়ে বড় শহর থেকে এখন পর্যন্ত লাখ লাখ বাসিন্দা পালিয়ে গেছে। যেখানে গত মাসেই জাতিসংঘের সমর্থিত একটি সংস্থা দুর্ভিক্ষের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
কিন্তু আরও লাখ লাখ মানুষ সেখানে এখনো ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতিতে রয়েছে। স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিষেবা সেখানে ভেঙে পড়েছে।
এদিকে মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ বলেছেন, গত মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে আরব মুসলিম নেতাদের এক দলের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘মধ্যপ্রাচ্য ও গাজায় শান্তির জন্য ২১ দফা পরিকল্পনা’ উপস্থাপন করেছেন।
এই পরিকল্পনা সম্পর্কে উইটকফ বিস্তারিত আর কিছু জানাননি। তবে তিনি বলেছেন, এটা ইসরায়েলের উদ্বেগের পাশাপাশি এই অঞ্চলের সব প্রতিবেশীর দুশ্চিন্তাকে তুলে ধরেছে। আমরা আশাবাদী, এমনকি আমি আত্মবিশ্বাসী হয়েও বলতে পারি, আগামী দিনগুলোতে আমরা যেকোনো ধরনের যুগান্তকারী সাফল্য ঘোষণা করতে পারব।
গাজা সিটির হাসপাতালগুলো গত বুধবার বিকেলে জানিয়েছে, তারা মধ্যরাত থেকে ইসরায়েলি হামলা ও গুলিবর্ষণে নিহত ৬০ জনেরও বেশি মানুষের মরদেহ পেয়েছে।
হামাস পরিচালিত সিভিল ডিফেন্স এজেন্সি জানিয়েছে, ফাইরাস মার্কেটের কাছে বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত একটি ওয়্যারহাউসে ইসরায়েলি হামলায় এক তৃতীয়াংশ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে ছয়জন নারী এবং নয়জন শিশু রয়েছে।
বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের গাজা সিটিতে স্বাধীনভাবে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তাই এসব সংবাদ ভেরিফাই বা যাচাই করা কঠিন। কিন্তু ঘটনাস্থলের একটি ভিডিও ফুটেজে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে কম্বলে মোড়ানো একটি মরদেহ সরিয়ে নিতে দেখা গেছে লোকজনকে।
নিহতদের মধ্যে মোহাম্মদ হাজ্জাজের আত্মীয়ও রয়েছে। তিনি এএফপি নিউজকে বলেছেন, যখন লোকজন ঘুমাচ্ছিল তখন ওই স্থানে ‘ব্যাপক বোমা হামলা’ চালানো হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা এসে শিশু ও নারীদের ছিন্নভিন্ন অবস্থায় দেখতে পেয়েছি। এটি এক করুণ দৃশ্য ছিল। আরেকটি ছবিতে দেখা গেছে, আল আহলি হাসপাতালের বাইরে মেঝেতে সাদা কাফন এবং প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখা ছয়টি মরদেহের পাশে বসে মানুষ শোক পালন করছে।
তালা আল-দীব নামে এক নারী জানিয়েছেন, মরদেহগুলোর মধ্যে তার বোনের স্বামী, দুই সন্তান এবং বোনের শ্বশুরসহ চারজনের মরদেহ রয়েছে।
এ বিষয়ে ইসরায়েলি ডিফেন্স বাহিনীর মন্তব্য জানতে চাইলে তারা বলেছে, দুই হামাস সন্ত্রাসীকে লক্ষ্য করে হামলা করেছে তারা।
গাজা সিটির অন্যান্য স্থানের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দক্ষিণ-পশ্চিম তেল আল-হাওয়া এবং উত্তর-পশ্চিম রিমাল পাড়ায় ইসরায়েলি ট্যাংক দেখতে পেয়েছেন তারা।
ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট গত মঙ্গলবার জানিয়েছে, তাল আল-হাওয়ার আল-কুদস হাসপাতালের বাইরে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর বাহন মোতায়েন করা হয়েছে এবং ইসরায়েলি গুলিবর্ষণে এর অক্সিজেন স্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অকেজো হয়ে গেছে।
আইডিএফ গত বুধবার জানিয়েছে, হাসপাতালের দিকে সরাসরি কোনো হামলা চালানো হয়নি। এই ঘটনার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে তারা।
গাজায় যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা উপস্থাপন করলেন ট্রাম্প
গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২১-দফা একটি নতুন পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন।
গত মঙ্গলবার নিউইয়র্কে আরব ও মুসলিম নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠকে এই পরিকল্পনাটি নিয়ে আলোচনা করা হয়। গত বুধবার সিএনএনকে দেওয়া তথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এই খবর জানিয়েছেন। ট্রাম্পের সঙ্গে এই বৈঠকে তিনিসহ আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
উইটকফ বলেন, ‘আমরা বেশ ফলপ্রসূ আলোচনা করেছি। বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ২১-দফা পরিকল্পনাটি আরব নেতাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি যে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে একদিকে যেমন গাজায় সহিংসতা বন্ধ হবে, তেমনি ইসরায়েল এবং তার প্রতিবেশী দেশগুলোর উদ্বেগও দূর হবে।’
তিনি আরও আশা প্রকাশ করেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এই বিষয়ে কোনো ধরনের অগ্রগতির ঘোষণা আসবে। ট্রাম্পের পরিকল্পনার কয়েকটি মূল বিষয় হলো: গাজায় আটক সব জিম্মিকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া, গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করা, গাজার প্রশাসনকে হামাসের প্রভাবমুক্ত করা এবং পর্যায়ক্রমে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের প্রত্যাহার করা।