কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলাকে কেন্দ্র করে টানা কয়েক দিনের তীব্র উত্তেজনার পর মঙ্গলবার মধ্যরাতে পাকিস্তান-অধিকৃত আজাদ কাশ্মীরের ৯টি স্থানে একযোগে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। পাকিস্তান বলছে, হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত ও ৪০ জনের বেশি আহত হয়েছে। আর ভারতের দাবি, তাদের হামলায় কমপক্ষে ৭০ জন নিহত হয়েছে। দিল্লির দাবি, নিহতদের সবাই সন্ত্রাসী। ভারত এ অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’।
অন্যদিকে ভারতের হামলার জবাবে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে পাল্টা হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ভারতীয় সেনাবাহিনী জানিয়েছে, সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলোয় পাকিস্তানি বাহিনীর গোলার আঘাতে নিহত বেসামরিক ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা বেড়ে ১৫ জন হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র রয়টার্সকে জানিয়েছেন, পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছে।
এর মধ্যে তিনটি ফ্রান্সের তৈরি রাফাল, একটি রাশিয়ার তৈরি সু-৩০ ও অন্যটি মিগ-২৯। সু-৩০ ও মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান সোভিয়েত আমলে তৈরি। ভারতের চার সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স আরও জানিয়েছে, জম্মু ও কাশ্মীরে বুধবার তিনটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে পাকিস্তানের দাবির বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে কিছু নিশ্চিত করা হয়নি। এনিয়ে আনুষ্ঠানিক কোন বক্তব্যও দেয়নি নয়াদিল্লি।
এদিকে পাল্টাপাল্টি হামলা প্রতিবেশী দেশকে সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ভারতের হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ জরুরি নিরাপত্তা বৈঠকে বসেছেন। হামলার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেছেন, প্রতিশোধ নেয়ার সবঅধিকার পাকিস্তানের রয়েছে। এক্সে দেয়া এক বার্তায় তিনি বলেন, পাকিস্তানের পাঁচটি জায়গায় কাপুরুষোচিত হামলা চালিয়েছে শত্রুরা।
তিনি ভারতের এই হামলাকে ‘অ্যাক্ট অফ ওয়ার’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। শাহবাজ শরিফ তার পোস্টে লিখেছেন, ভারতের এই যুদ্ধের উপযুক্ত জবাব দেওয়ার পূর্ণ অধিকার পাকিস্তানের রয়েছে এবং তাদের যোগ্য জবাবও দেয়া হচ্ছে। পাকিস্তানের পুরো জনগণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছে এবং দেশের মনোবল একেবারে মজবুত রয়েছে। শাহবাজ বলেন, পাকিস্তান কখনোই ভারতকে নিজেদের ‘উদ্দেশ্যে সফল’ হতে দেবে না।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ জানিয়েছেন, সাতটি লক্ষ্যবস্তুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, হতাহতের সবশেষ সংখ্যা আমার কাছে নেই, তবে নিশ্চিত হওয়া সাতটি লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে দু’টি কাশ্মীরে এবং পাঁচটি পাকিস্তানে। সবকটি ক্ষেত্রে নিশানা ছিলো বেসামরিক নাগরিকেরা। লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে দু’টি মসজিদও ছিল। এক শিশু শহীদ হয়েছে এবং এক নারী শহীদ হয়েছেন।
হামলার পর পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। হাসপাতালসহ জরুরি সব ধরনেরসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। বেসামরিক প্রতিরক্ষা কর্মীদের নিজ নিজ দায়িত্বে ফেরত যেতে বলা হয়েছে। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী মরিয়ম নওয়াজ শরিফ বুধবার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
পাকিস্তানে হামলা নিয়ে ভারত যা বলছে:
গতকাল বুধবার দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানে হামলার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। তিনি বলেন, বুধবার রাত ১টা ৫ মিনিট থেকে দেড়টা পর্যন্ত পাকিস্তানি ভূখণ্ডে হামলা চালানো হয়েছে। ভারতের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী যৌথভাবে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামের এই অভিযান পরিচালনা করেছে। ২৫ মিনিটে ৯টি লক্ষ্যবস্তুতে ২৪টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ভারতীয় বাহিনী।
সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার ভায়োমিকা সিংহ উপস্থিত ছিলেন। মিশ্রি বলেছেন, জম্মু-কাশ্মিরের পেহেলগামে গত ২২ এপ্রিলের সন্ত্রাসী হামলার জবাবে পাকিস্তানে হামলা করা হয়েছে। পেহেলগামের ওই হামলায় ২৫ ভারতীয় ও এক নেপালি নাগরিকের প্রাণহানি ঘটে।
হামলা নিয়ে পাকিস্তান যা বলেছে
এ ঘটনাকে ‘যুদ্ধের শামিল’ ও ‘আগ্রাসন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তান। দেশটির সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ বলেন, ‘পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ও পাঞ্জাব প্রদেশের পূর্বাঞ্চলে আঘাত হেনেছে ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র।’ তবে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, ‘ভারতের বিরুদ্ধে হামলার পরিকল্পনা হচ্ছে, এমন অন্তত ৯টি স্থানে আঘাত হানা হয়েছে।’
আহমেদ শরিফ বলেন, ‘ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলায় পাকিস্তানে অন্তত ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে ২৬ জন ক্ষেপণাস্ত্রে, আর পাঁচজন গোলার আঘাতে নিহত হন।’
যেকোনো সময় হামলার জবাব দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর এই মুখপাত্র। তিনি বলেন, ‘কোথায় ও কীভাবে জবাব দেব, সেটা একান্তই আমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত।’
হামলা পাল্টা হামলার মধ্যেও দুদেশের কোনো যুদ্ধবিমান একে অপরের সীমান্ত লঙ্ঘন করেনি বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ অধিদপ্তর। আইএসপিআরের মহাপরিচালক জেনারেল আহমেদ চৌধুরী দাবি করেছেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর প্রেক্ষিতে সীমান্ত পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলেও ভারতের কোনো যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ করেনি এবং পাকিস্তানের যুদ্ধবিমানও ভারতের আকাশসীমায় যায়নি। তিনি বলেন, পাকিস্তান তার সীমান্ত থেকেই ভারতে হামলার প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, কোনো সময়ই ভারতের কোনো যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ করেনি এবং একইভাবে পাকিস্তানের কোনো যুদ্ধবিমানও ভারতের আকাশসীমায় যায়নি। জেনারেল আহমেদ আরও দাবি করেন, ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পূর্ণভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং একাধিক ভারতীয় চৌকি ধ্বংস করেছে। তিনি ভারতীয় একটি ইউনিট ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের ভিডিও ফুটেজ প্রদর্শন করেন, যেগুলো লক্ষ্য করে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করা হয়।
কাশ্মীর সীমান্তে উত্তেজনা চরমে, গোলাগুলি
মঙ্গলবার দিবাগত রাতে হামলা-পাল্টা হামলার উত্তেজনা ছড়িয়েছে সীমান্তেও। পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এপি ও রয়টার্স জানিয়েছে, লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) বরাবর ভারত ও পাকিস্তান সেনাদের মধ্যে গোলাগুলি ও মর্টার হামলা শুরু হয়েছে। এক বিবৃতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ভারতশাসিত কাশ্মীরে পাকিস্তানি সেনাদের গোলাবর্ষণে তিনজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
ভারতের সাদা পতাকা তোলার দাবি পাকিস্তানের
সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনী ‘সাদা পতাকা’ উড়িয়েছে বলে দাবি করেছে পাকিস্তান। দেশটি বলছে, সীমান্তে সাদা পতাকা উত্তোলন করে ভারত পরাজয় স্বীকার করেছে। বুধবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়ে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম এআরওয়াই নিউজ বলছে, ভারত নিয়ন্ত্রণ রেখায় সাদা পতাকা উত্তোলন করে কার্যকরভাবে পরাজয় স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার।