লোকসভার এবারের নির্বাচনি দৌড়ে ছিল মূলত দু’টি জোট। প্রথমত, বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ। দ্বিতীয়ত, কংগ্রেসসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির যৌথমঞ্চ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স-ইন্ডিয়া।
ফল বলছে, শেষ পর্যন্ত বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটকে হারাতে না পারলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দলের নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়ার সম্ভাবনায় ইতি টেনে দিয়েছে সাড়ে ১১ মাস আগে গড়ে ওঠা এই বিরোধী জোট।
ভারতজুড়ে একযোগে ভোট গণনা চলছে। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত গণনায় ভোটের ফল ও প্রবণতা বলছে যে এককভাবে বিজেপির আসন সংখ্যা ২৪০-এর আশপাশে হতে চলেছে। সূত্র: আনন্দবাজার
৫৪৫ আসনের (দুটি মনোনীত আসনসহ) লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ২৭৩টি। অর্থাৎ, কেন্দ্রে সরকার গড়ার জন্য টিম মোদিকে নির্ভর করতে হবে এনডিএর দুই শরিক চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) ও নীতিশ কুমারের জেডিইউ-এর ওপর।
একটি সূত্রের খবর, ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কলেবর বাড়াতে ইতোমধ্যে সক্রিয় হয়েছেন এনসিপি(এস) প্রধান শারদ পাওয়ার। এনডিএর বেশ কয়েকজন শরিক নেতার সঙ্গেও তার যোগাযোগ হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আশা প্রকাশ করেছেন, আরও কিছু দল অদূর ভবিষ্যতে ‘ইন্ডিয়া’য় শামিল হবে।
বেঙ্গালুরুতে গত বছরের ১৯ জুলাই অনুষ্ঠিত বিজেপিবিরোধী নেতাদের দ্বিতীয় বৈঠকে ‘ইন্ডিয়া’র আবির্ভাব হয়। এর সঙ্গেই ইতিহাসের পাতায় চলে যায় ১৯ বছর আগে গড়ে ওঠা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ (ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স)।
ইউপিএ-র যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে। তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে ওই বছর লোকসভা ভোটের আগেই অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে ওই জোট। সেই জোটের নেতৃত্বেই পর পর দু’বার ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রে সরকার গঠিত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন মনমোহন সিং।
এবার ‘ইন্ডিয়া’র শরিক দলগুলোর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ বা আংশিক আসন সমঝোতা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল, কেরালায় বাম, পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টি (আপ), জম্মু ও কাশ্মীরে পিডিপির মতো কেউ আবার কংগ্রেসের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। ভোটের পর জোটের প্রতিশ্রুতিতে তারা নিজেদের রাজ্যে আলাদা করে লড়েছেন।
২০২৩ সালের ২৩ জুন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তথা জেডিইউ প্রধান নীতিশ কুমারের ডাকে পাটনার বিরোধী জোটের বৈঠকে ১৫টি দল ছিল। জুলাইয়ে বেঙ্গালুরুতে সেই তালিকা বেড়ে হয় ২৬। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারিতে নীতিশ সদলবলে ফিরে গিয়েছিলেন বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-তে। মার্চে বিজেপির সহযোগী হয়েছিলেন চন্দ্রবাবু।
গত বছরের জুলাইয়ে নতুন জোট ‘ইন্ডিয়া’ ঘোষণার সময় যে দলগুলো ছিল সেগুলো হল- কংগ্রেস, তৃণমূল, ডিএমকে, আম আদমি পার্টি (আপ), জেডিইউ, রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি), ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম), এনসিপি (শারদ), শিবসেনা (উদ্ধব), সমাজবাদী পার্টি, রাষ্ট্রীয় লোকদল, আপনা দল (কে), ন্যাশনাল কনফারেন্স, পিডিপি, সিপিএম, সিপিআই, সিপিআই (এমএল) লিবারেশন, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক, এমডিএমকে, ভিসিকে, কেডিএমকে, এমএমকে, ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ, কেরালা কংগ্রেস (মণি) এবং কেরালা কংগ্রেস (জোসেফ)। জেডিইউ-র পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশের আপনা দলও (কে) এখন জোটের বাইরে।
প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে গড়ে উঠেছিল এনডিএ। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাজপেয়ির প্রধানমন্ত্রিত্বে এই জোটের সরকার ছিল। তারপর ২০১৪ ও ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে জিতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ফের সরকার গঠন করে এই জোট।
তবে গত এক বছরে অন্যতম শরিক পাঞ্জাবের শিরোমণি আকালি দল, তামিলনাড়ুর এডিএমকে, জম্মু ও কাশ্মীরের পিডিপি, হরিয়ানার জেজেপি, রাজস্থানের রাষ্ট্রীয় লোকতান্ত্রিক পার্টি মোদির সঙ্গ ছেড়েছে। সহযোগী পাওয়ার জন্য উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা এবং শারদ পওয়ারের এনসিপি ভেঙে প্রতীক দখলের অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে।
আবার জেডিইউর পাশাপাশি এনডিএ ছাড়ার পরও ফেরত এসেছে অন্ধ্রের তেলেগু দেশম পার্টি, তামিলনাড়ুর পিএমকে, আসামের আসাম গণপরিষদ, এমনকি এলজেপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ানের ছেলে চিরাগ।
উত্তরপ্রদেশের রাষ্ট্রীয় লোকদল, কর্নাটকের জেডিএস, অন্ধ্রের জনসেনার ত্রিপুরার তিপ্রা মথার মতো নতুন সহযোগীও পেয়েছে তারা। মায়াবতীর বিএসপি, নবীন পট্টনায়কের বিজেডি বা জগন্মোহন রেড্ডির ওয়াইএসআর কংগ্রেস কোনো শিবিরে না থাকলেও ‘সঙ্কটের মুহূর্তে’ মোদির পাশে দাঁড়াতে পারে বলেও ভোটের আগে মনে করছিলেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে শূন্য হয়ে গেছেন মায়াবতী। নবীন ও জগন নিজেদের রাজ্যে বিজেপি এবং তার জোটসঙ্গীর কাছে পর্যদুস্ত হওয়ায় তাদের এনডিএকে সমর্থনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ওড়িশায় বিজেডি পেয়েছে মাত্র একটি আসন। অন্ধ্রে ওয়াইএসআরসিপির প্রাপ্ত আসন চার।