রাশিয়ায় বিমান বিধ্বস্ত হয়ে রুশ ভাড়াটে যোদ্ধা বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের মৃত্যুর খবর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভিন্ন মাত্রার উত্তাপ ছড়াচ্ছে। চলছে নানামুখী বক্তব্য, বিশ্লেষণ।
ওয়াগনার বাহিনী ও এর সমর্থক গোষ্ঠীর কাছে এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও তাদের এমন দাবিকে একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
ইউক্রেন যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে ওয়াগনার বাহিনী ২৩ জুন মস্কো দখলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তাদের এই বিদ্রোহের পরিণতিই বাহিনী প্রধান প্রিগোজিন ভোগ করেছেন বলে মনে করছেন অনেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি জানি না ঠিক কী হয়েছে। তবে রাশিয়ায় পুতিনের নির্দেশ ছাড়া তেমন কিছুই ঘটে না।’
প্রিগোজিনের আগেও পুতিনের বিরোধিতা করে করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে অনেককে। এ তালিকায় রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা আলেক্সেই নাভালনিসহ রয়েছেন আরও অনেকে।
আলেক্সেই নাভালনি
রাশিয়ায় পুতিনের প্রধান সমালোচক নাভালনি। ২০২১ সাল থেকে কারাগারে আছেন ৪৭ বছর বয়সী এই ধনকুবের রাজনীতিক।
প্যারোলের শর্ত লঙ্ঘন, প্রতারণা ও আদালত অবমাননার অভিযোগে ৯ বছরের সাজার পর ৫ আগস্ট নাভালনিকে আরও ১৯ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তবে নাভালনি ও তার সমর্থকদের দাবি, সব অভিযোগই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
মেলেখোভোয় একটি পেনাল কলোনিতে রাখা হয়েছে নাভালনিকে। মূলত নির্বাসিত বন্দিদের এসব কলোনিতে অন্য কয়েদিদের থেকে আলাদা করে রাখা হয়।
২০২০ সালে সাইবেরিয়ায় নাভালনিকে বিষপ্রয়োগ করা হয়। ওই বছরের ২০ আগস্ট সাইবেরিয়া থেকে আকাশপথে মস্কো যাওয়ার পথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাশিয়ায় কিছুদিন চিকিৎসার পর তাকে জার্মানিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
পুতিনের সমালোচকরা ওই সময় অভিযোগ তোলেন, পথের কাঁটা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দিতে ক্রেমলিন এই বিষ প্রয়োগ করেছে। অবশ্য এ ধরনের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে ক্রেমলিন।
জার্মানিতে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ২০২১ সালে দেশে ফেরার পরপরই নাভালনিকে গ্রেপ্তার করে সরকারি বাহিনী। পরে প্যারোলের শর্ত লঙ্ঘন, প্রতারণা ও আদালত অবমাননার দায়ে তাকে ৯ বছরের সাজা দেয় দেশটির আদালত।
সের্গেই স্ক্রিপাল
স্ক্রিপাল রাশিয়ার একজন দুর্ধর্ষ এসপিওনাজ এজেন্ট ছিলেন। তাকে ডবল এজেন্ট বলা হতো। কর্মজীবনে তিনি ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থাকে তথ্য সরবরাহের দায়ে অভিযুক্ত হন। পরে ২০১৮ সালের মার্চে স্ক্রিপাল ও তার মেয়ে ইউলিয়াকে যুক্তরাজ্যের সালিসবেরি শহরে একটি শপিং সেন্টারের বাইরের বেঞ্চে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়।
তাদের গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের ওপরও বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল বলে চিকিৎসকরা জানান।
বাবা ও মেয়ে ১৯৭০-৮০’র দশকে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর গঠন করা নার্ভ এজেন্ট গ্রুপের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন বলে সে সময় ব্রিটিশ কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন।
এই অভিযোগও অস্বীকার করে রাশিয়া। ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে উল্টো বলা হয়, একটি রুশ-বিরোধী মনোভাব প্রতিষ্ঠার জন্যই ব্রিটেন এমন অপবাদ দিচ্ছে।
ভলাদিমির কারা-মুর্জা
ভলাদিমির ক্লারা-মুর্জা রাশিয়ার পুতিনবিরোধী অধিকার-কর্মীদের অন্যতম একজন। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তাকে বিষ প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে।
জার্মানিতে পরীক্ষাগারে তার শরীরে উচ্চমাত্রায় পারদ, তামা, ম্যাঙ্গানিজ ও জিঙ্কের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
ওই ঘটনায়ও বরাবরের মতোই নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে রাশিয়া।
আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কো
রুশ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি’র এজেন্ট ছিলেন আলেকজান্ডার লিটভিনেঙ্কো। পুতিনের সমালোচক লিটভিনেঙ্কো ২০০৬ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মারা যান।
রাশিয়া থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডে যাওয়ার ৬ বছর পর লন্ডনের মিলেনিয়াম হোটেলে গ্রিন টি পান করে তার মৃত্যু হয় বলে খবর আসে।
পরে জানা যায়, ওই চায়ে পোলোনিয়াম-২১০ নামের একটি বিরল ও শক্তিশালী তেজস্ক্রিয় পদার্থ মেশানো ছিল।
২০১৬ সালে পুতিনকে দোষী সাব্যস্ত করে তদন্ত শেষ করে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। তবে সেবারও নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়ে অভিযোগ অস্বীকার করে ক্রেমলিন।
আলেকজান্ডার পেরিপিলিচনি
৪৪ বছর বয়সী এই রাশিয়ানের মরদেহ পাওয়া যায় লন্ডনে তারই বিলাসবহুল বাড়ির সামনে। ২০১২ সালের নভেম্বরে প্রাতঃভ্রমণ শেষে বাড়ি ফেরার পথে তার মৃত্যু হয় বলে খবরে জানা যায়।
২০০৯ সালে রাশিয়ায় অর্থ পাচারের একটি ঘটনা তদন্তে সুইজারল্যান্ডকে সহযোগিতা করার পর ব্রিটেনে আশ্রয় চান পেরিপিলিচনি। এর তিন বছর পর তার মৃত্যু হলেও ওই ঘটনায় অভিযোগের আঙুল ওঠে রাশিয়ার দিকে।
পেরিপিলিচনি মৃত্যুও বিরল কোনো বিষক্রিয়ায় হয়েছে বলে জানায় ব্রিটিশ পুলিশ। তার পাকস্থলীতে জেলসেমিয়াম নামের এক উদ্ভিদ থেকে পাওয়া বিরল এবং শক্তিশালী বিষের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
রাশিয়ার একটি জনপ্রিয় খাবার খাওয়ার পর তার মৃত্যু হলেও এ ঘটনায় নিজেদের দায় স্বীকার করেনি মস্কো।
ভিক্টর ইউশচেঙ্কো
ভিক্টর ইউশচেঙ্কো তৎকালীন ইউক্রেনের বিরোধীদলীয় নেতা। ২০০৪ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনকালে তিনি ক্রেমলিনঘেঁষা প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন।
ইউক্রেনের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কিয়েভের বাইরে ডিনার করার সময় তার খাবারে বিষ প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায়ও রাশিয়া বরাবরের মতোই দায় এড়ানোর জবাব দেয়।
ভিক্টরের শরীরে স্বাভাবিকের চেয়ে হাজার গুণ বেশি ডাইঅক্সিন পাওয়া যায়। বিষক্রিয়ায় তার শরীর ও মুখ বেঁকে যায়। কয়েক ডজন অপারেশনের পর তাকে শেষ পর্যন্ত সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়।
পরে ভোটে তিনি বিজয়ী হন।
আন্না পলিটকোভস্কায়া
রাশিয়ায় মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে প্রাণ হারান সাংবাদিক আন্না পলিটকোভস্কায়া। ২০০৬ সালের ৭ অক্টোবর বাজার করে ফেরার পথে নিজের ফ্ল্যাটের বাইরে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
দুই সন্তানের জননী ৪৮ বছর বয়সী ওই নারী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়ে পশ্চিমা দেশগুলো। এ ঘটনা রাশিয়ায় কর্মরত সংবাদকর্মীদের জন্য হুমকি হিসেবে আখ্যা পায়।