কিশোর হত্যাকাণ্ডে বিক্ষোভে উত্তাল ফ্রান্সের দাঙ্গা স্তিমিত হয়ে আসছে। সহিংসতা শুরুর পাঁচ দিন পর দেশটির পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার আভাস মিলছে। নাতির মৃত্যুতে দেশের পরিস্থিতি এমন উত্তাল হয়ে ওঠায় বিব্রত হয়ে পড়েছেন নাহেলের দাদীও। বিক্ষোভকারীদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
রোববার ফ্রান্সের এফএম টিভিকে দেয়া সাক্ষাতকারে নাহেলের দাদী নাদিয়া বলেন, ‘বিক্ষেভের নামে যারা ভাংচুর করছে, তারা আসলে নাহেলের মৃত্যুকে অজুহাত বানিয়ে এগুলো করছে। আমি তাদের বলছি, এগুলো বন্ধ করুন।’
নাদিয়া বলেন, ‘প্রাইভেট কারগুলো তো কারও কিছু করেনি। বাসগুলোও নির্দোষ। আপনারা দয়া করে স্কুলগুলোর ক্ষতি করবেন না। যে বাসগুলো ভাঙছেন, সেগুলোতে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মায়েরা চলাফেরা করেন।’
নাহেল হত্যাকাণ্ডে তার ও তার মেয়ের (নাহেলের মা) ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেলেও ওই পুলিশ সদস্যদের কোনো অমঙ্গল তিনি চাননি বলে জানান।
নাতি হত্যায় ন্যায়বিচার চেয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি আমার আস্থা আছে। এমন নৃশংস কাজ যে পুলিশ অফিসার করেছে, তার অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। তাই বলে দেশের পুরো পুলিশ বিভাগকে এর জন্য দায়ী করা উচিত নয়।’
‘এ ঘটনায় আমি সত্যিই ব্যথিত!’
সোমবার এক প্রতিবেদনে বিবিসি জানায়, পুলিশের ওপর হামলা, নাশকতা, লুটপাট এবং সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধনে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে রোববার রাতেও ১৫০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ফ্রান্সের পুলিশ। শনিবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ৭০০ জনকে।
রোববার প্যারিসের একটি সড়কে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে দাঙ্গাকারীরা। ওই আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মী পুড়ে মারা যান।
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি মোকাবেলায় বৈঠক করেন প্যারিসের মেয়ররা। পরে এক যৌথ বিবৃতিতে সাধারণ জনগণকে দাঙ্গাবিরোধী মিছিলে নামার আহ্বান জানান তারা।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গত পাঁচদিন ধরে ভয়াবহ সহিংসতা হচ্ছে দেশজুড়ে। দাঙ্গাকারীরা চুড়ান্ত সহিংস মনোভাব নিয়ে প্রজাতন্তের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক ধ্বংসের নেশায় মেতে উঠেছে।
‘আমরা স্বীকার করছি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা এখনও সমাজ থেকে বৈষম্য নির্মূল করতে পারিনি। কিন্তু এটাও সত্য— দাঙ্গাকারীদের হাতে আমরা দেশকে ধ্বংস হতে দিতে পারি না। ফ্রান্সের শান্তিকামী জনগণ নিশ্চয়ই সেটি চায় না।’
২৭ জুন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের উপশহর নতেঁ পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ১৭ বছর বয়সী তরুণ নাহেল এম.। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ছেলেটি বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোয় পুলিশের নজরে পড়ে। সে সময় তাকে থামার ইঙ্গিত দিলেও সে ট্রাফিক চৌকি অতিক্রমের চেষ্টা করে। তারপর চৌকির এক পুলিশ সদস্যের গুলিতে নিহত হয় নাহেল।
নাহেল নিহতের ঘটনায় সেদিন থেকেই শহরটিতে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। সেদিন বিকেলে এক ভিডিওবার্তায় নাহেলের মা মুনিয়া তার ছেলেকে হত্যাকারী পুলিশ সদস্যের বিচার দাবি করেন। ফ্রান্সের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে মুহূর্তেই সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। পরে রাজধানী প্যারিসসহ দেশটির বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে ৪৫ হাজার পুলিশ মোতায়েন করে ফ্রান্স সরকার, কিন্তু বিক্ষোভ দাঙ্গায় রূপ নিলে ওই বাহিনীও অপর্যাপ্ত বলে মনে হয়।
পুলিশের বরাতে বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, বিক্ষোভের পাঁচ দিনে দাঙ্গাকারীরা অন্তত ১০টি শপিং মল, ২০০ সুপারমার্কেট, ২৫০টি তামাকজাত পণ্যের দোকান, ২৫০টি ব্যাংক ও শত শত সরকারি ভবনে হামলা-ভাংচুর ও লুটাপাট চালিয়েছে।
এর মধ্যে শনিবার রাত দেড়টার দিকে প্যারিসের আরেক উপশহর লিলেস রোজেসের মেয়র ভিনসেন্ত জ্যঁব্রুনের বাসভবনে হামলা চালায় একদল দাঙ্গাকারী। গেট ভেঙে মেয়রের বাড়িতে ঢুকে প্রথমে তারা গাড়ি ভাংচুর করে, তারপর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
সেসময় এক জরুরি বৈঠকে টাউন হলে ছিলেন মেয়র। বাড়িটিতে ৫ ও ৭ বছর বয়সী দুই সন্তানসহ ঘুমিয়েছিলেন তার স্ত্রী। দাঙ্গাকারীদের উপস্থিতি টের পেয়ে সন্তানদের নিয়ে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় এক সন্তান ও তিনি আহত হন।
বিবৃতিতে ঘটনাটি উল্লেখ করে বলা হয়, ‘ফ্রান্স আজ বিপন্ন। দেশের শান্তিকামী জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা দাঙ্গাবিরোধী শান্তিকামী মিছিল বের করুন।’
মেয়রদের ওই বিবৃতির পর বিক্ষোভ খানিকটা শান্ত হয়ে এসেছে। বৃহস্পতিবার রাতে যেখানে ১৯০০ গাড়ি জ্বালিয়েছিল বিক্ষোভকারীরা, সেখানে রোববার রাতে গাড়ি জ্বালানোর সংখ্যা নেমে আসে ২৯৭টিতে। বৃহস্পতিবার ৫০০টি ভবনে ভাংচুর ও জ্বালাও-পোড়াও হলেও রোববার ৩৪টি ভবনে ভাংচুর চালায় দাঙ্গাকারীরা।
নতেঁ উপশহরটিতে মূলত আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কো থেকে আসা অভিবাসীদের বাস। নাহেল ও তার মা মুনিয়াও আলজেরীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম। দুই-তিন প্রজন্ম ধরে ফ্রান্সে বসবাস করলেও এ অভিবাসীদের বরাবরের অভিযোগ- তারা বৈষমের শিকার।