সর্বোচ্চ নেতার প্রশংসা করে গান গাইতে অস্বীকার করায় ইরানের এক স্কুলছাত্রীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী, এমনটাই দাবি করেছে ইরানের টিচার্স ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সমন্বয়কারী কাউন্সিল।
কাউন্সিল জানায়, ১৩ অক্টোবর নিরাপত্তা বাহিনী আরদাবিল শহরের শাহেদ গার্লস হাই স্কুলে অভিযান চালানোর সময় ১৬ বছর বয়সী আসরা পানাহি আহত হয়।
একদল ছাত্রী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির প্রশংসাযুক্ত গান গাইতে অস্বীকার করায় নিরাপত্তা বাহিনী তাদের মারধোর করে। এ সময় আহত অনেক ছাত্রীকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তাদের মধ্যে আসরা পানাহিও ছিল। এ ছাড়া বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়।
চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় শুক্রবার হাসপাতালে পানাহি মারা যায়।
তার মৃত্যুতে দেশটিতে নতুন করে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
শনিবার থেকে আরদাবিলের বাসিন্দারা বিক্ষোভ শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা গেছে, বিক্ষুব্ধরা জড়ো হয়ে ‘স্বাধীনতা, স্বাধীনতা, স্বাধীনতা’ স্লোগান দিচ্ছে এবং নিরাপত্তা বাহিনী ও পাথর নিক্ষেপকারী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে।
ইরানের কর্মকর্তারা এবারও পানাহি হত্যার দায় অস্বীকার করেছেন। দেশটির রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলে একজন ব্যক্তিকে পানাহির চাচা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, সেই ব্যক্তি জানান পানাহি জন্মগত হৃদরোগের সমস্যায় মারা গেছে।
তবে সেই ব্যক্তি আসলেই আসরা পানাহির চাচা কি না তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
গত সপ্তাহ থেকেই ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী স্কুলগুলোতে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করছে। কর্মকর্তারা ক্লাসরুমে ঢুকে পড়ছেন এবং স্কুলছাত্রীদের গ্রেপ্তার করছেন, মারধোর করছেন। স্কুলভবনে টিয়ার শেলও নিক্ষেপ করছে নিরাপত্তা বাহিনী।
রোববার পোস্ট করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, ইরানের শিক্ষক ইউনিয়ন নৃশংস ও অমানবিক অভিযানের নিন্দা করেছে এবং শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ নুরির পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকেও ইরানের নৈতিকতা পুলিশ সদস্যরা দুই কিশোরীকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন বলে জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
এর মধ্যে ১৬ বছর বয়সী সারিনা ইসমাইলজাদেহকে লাঠি (ব্যাটন) দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়েছিল। বিক্ষোভ চলাকালীন নৈতিকতা পুলিশের অফিসাররাই তাকে আঘাত করেন।
আঘাতে তার মাথার খুলি চূর্ণ হয়ে যাওয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মারা যায়।
এদিকে আরেক ১৭ বছর বয়সী কিশোরী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয়া নিকা শাকরামি নিখোঁজ ছিলেন। শুরুতে তাকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করে পুলিশ।
বাঁয়ে নিকা শাকরামি (১৭), ডানে- সারিনা ইসমাইলজাদেহ (১৬)
পরে তার মৃতদেহ ফিরিয়ে দিলে দেখা যায় তার নাক কেটে ফেলা হয়েছিল এবং মাথায় ২৯টি আঘাতের চিহ্ন।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় অ্যামনেস্টি বলেছে, ‘ইরানি কর্তৃপক্ষ জেনেশুনে এমন মানুষের ক্ষতি বা হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যারা কয়েক দশকের দমন ও অবিচারের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে রাস্তায় নেমেছে।’
তবে মাহসার মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট আন্দোলনকে ইরানি কর্তৃপক্ষ ইসরায়েল ও আমেরিকার চক্রান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছে।
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পরই নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়। বাধ্যতামূলক এই পোশাকবিধি মুসলিম নারীসহ ইরানের সব জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মের নারীদের জন্য প্রযোজ্য।
একেবারে শুরু থেকেই বিভিন্ন সময়ে পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে ইরানি নারীরা।
হিজাব আইন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগের জন্য চলতি বছরের ৫ জুলাই ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি একটি আদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে ‘সঠিক নিয়মে’ পোশাকবিধি অনুসরণ না করা নারীদের সরকারি সব অফিস, ব্যাংক ও গণপরিবহনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।