পুলিশি হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যু কেন্দ্র করে ইরানে ব্যাপক জনবিক্ষোভ চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে দেশটির অভিজাত রাজনীতিকদের কপালে। দেশকাঁপানো এই বিক্ষোভ বিদেশি গোয়েন্দা ষড়যন্ত্রের ফসল, নাকি পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেটের প্রভাব তা নিয়ে বিতর্ক চলছে বিশ্লেষকদের মধ্যে। তরুণ প্রজন্ম ইসলামি বিপ্লবের মূল্যবোধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কি না, তা নিয়েও চলছে বিশ্লেষণ।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত নিবন্ধ ভাষান্তর করা হয়েছে নিউজবাংলার পাঠকের জন্য।
নানা বিতর্কে ঘেরা এই আলোচনাটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে নির্ধারিত হবে ইরানের রাজনৈতিক ওপরমহল এখন কী করবে। তারা বিক্ষোভকারী ও বাইরের শক্তির ওপর ক্র্যাকডাউন চালিয়ে প্রতিশোধের পথ বেছে নেবে, নাকি নেতৃত্বহীন তরুণদের সঙ্গে কোনো ধরনের সংলাপে বসবে।
প্রথম পদক্ষেপটি নিলে এবং তারপরও বিক্ষোভ বাড়তে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা পুনরুজ্জীবিত করার পশ্চিমা দাবি আরও সংকুচিত হয়ে আসবে। ইরানের চলতি সরকার সংস্কারে সক্ষম কি না, সেটিরও পরীক্ষা হবে।
ইরান সরকারের সঙ্গে কাজ করছেন এমন কয়েকজন পর্যবেক্ষক বর্তমানে দেশটির নৃশংসতার মাত্রায় নমনীয়তা দেখছেন। তারা বলেছেন, চলমান বিক্ষোভে ২০০ জনের বেশি প্রাণ হারালেও এই সংখ্যা ২০০৯ সালের বিক্ষোভে কয়েক দিনের মধ্যে ৪০০ জন নিহত হওয়ার তুলনায় কম। তারা এটাও মনে করাচ্ছেন, ২০০৯ সালের বিক্ষোভের পর শত শত মানুষকে কাহরিজাক কারাগারে নির্যাতন করা হয়।
ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডস কর্পস যে অঞ্চলকে বিচ্ছিন্নতাবাদীপ্রবণ বলে মনে করে সেই কুর্দিস্তান মাহসা আমিনির মৃত্যুকে কাজে লাগাচ্ছে। গত মাসে নৈতিকতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর মাহসা মারা যান। এরপর ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ।
চলমান বিক্ষোভ ঘিরে অনিশ্চয়তার অন্যতম কারণ হলো ইরান সরকার বিশ্বাস করে, নেতৃত্বহীন এসব বিক্ষোভ মিইয়ে যাবে। সরকারের দাবি, মাত্র ৮০ হাজার লোক রাস্তায় নেমেছে এবং প্রতিবাদকারীদের বিপ্লব সংঘটন বা নেতা তৈরির সামর্থ্যের অভাব রয়েছে।
এই দাবির সঙ্গে বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশ একমত। তবে পশ্চিমাদের অধিকাংশই নারীর বৃহত্তর ব্যক্তিগত স্বাধীনতার দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল। একজন পশ্চিমা পর্যবেক্ষক এমন মন্তব্যও করেছেন, তাদের (বিক্ষোভকারী) ‘কোনো ম্যান্ডেলা নেই, অং সান সু চি নেই’।
রেভল্যুশনারি গার্ডরা এ বিক্ষোভকে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখতে চাইছেন না। তাদের মতে, এটি পশ্চিমা ও সৌদি মদতে চলা ইরান ইন্টারন্যাশনাল চ্যানেলের ষড়যন্ত্র।
রেভল্যুশনারি গার্ডকে সমর্থনকারী সংবাদপত্র জাভান বলছে, এ ষড়যন্ত্রের হোতা যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্যপ্রাচ্য বিভাগের সাবেক প্রধান স্টেফানি আল-কাক।
পত্রিকাটির দাবি, আল-কাক দাঙ্গা শুরুর কয়েক দিন আগে ইরানে আসেন ও পরিস্থিতির ব্যবস্থাপনা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। রয়টার্স ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একজন কর্মী হিসেবে তার অতীতের রেকর্ডের দিকে ইঙ্গিত করে পত্রিকাটি বলেছে, আল-কাক ‘একজন সংযোগকারী ও দেশের অভ্যন্তরে বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি সাম্প্রতিক গোলমালের নির্দেশনা দিয়েছেন ও মিডিয়ার ফিল্ড অপারেশন নির্ধারণে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।’
তেহরানে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত সাইমন শেরক্লিফ অবশ্য এ দাবিকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
রেভল্যুশনারি গার্ডের কমান্ডার হোসেন সালামিও দাবি করছেন, বিক্ষোভের পেছনে উসকানিদাতাদের ভূমিকা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইরানের রাস্তা থেকে সাম্প্রতিক অস্থিরতার শিকড় ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, লন্ডন, তেল আবিব ও রিয়াদের কেন্দ্রে নিয়ে যাব।’
তার যুক্তি হলো, এই সংঘাতকে একটি সফল ইসলামি বিপ্লব ও ঈর্ষান্বিত পতনশীল পশ্চিমের মধ্যে লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, বিক্ষোভকারীদের প্রতিটি মোলোটভ ককটেলের জন্য ৫০ হাজার তোমান (দেড় ডলার বা প্রায় ১৬০ টাকা) দেয়া হয়েছে।
৮৩ বছর বয়সী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা, আলি খামেনি সংলাপ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এবং বিক্ষোভকে ‘ছোট ঘটনা’ ও ‘বিচ্ছিন্ন দাঙ্গা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
তিন দশক ধরে খামেনির বৈধতা ও উত্তরাধিকারকে চ্যালেঞ্জ করা যাচ্ছে না। তারা মাহসার মৃত্যুকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং সরকারি তদন্তে দাবি করা হয়েছে মাহসার মৃত্যু স্বাভাবিক। তবে বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
ইরান ধর্মনিরপেক্ষকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার রাস্তা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। প্রায় ৩০ লাখ ইরানি বার্ষিক আরবাইন তীর্থযাত্রায় ইরাকে গেছেন। এর আনুষ্ঠানিকতা ইমাম হুসেইনের হত্যাকে স্মরণ করে ৪০ দিনের শোকের সমাপ্তি চিহ্নিত করে। এই ধর্মানুরাগ দেখে ইরানের আলেমরা আনন্দিত।
চলমান বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের গড় বয়স প্রায় ২০-এর আশপাশে। এ নিয়ে আলেমদের বক্তব্য হলো, কীভাবে তারা দেশের তরুণদের একটি অংশকে হারিয়েছেন সে সম্বন্ধে আত্ম-অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
ইরানে ইন্টারনেট নিয়ে বিবাদ অনেক দিনের। পশ্চিমা ইন্টারনেটের অনুপ্রবেশকে ঐতিহ্যগত ইসলামি মূল্যবোধে আঘাত ও ব্যবহারকারীদের মনস্তত্ত্বে পরিবর্তনের জন্য দায়ী করছেন দেশটির অনেক রক্ষণশীল। এই সপ্তাহে একজন আলেম দাবি করেছেন, ইন্টারনেট ক্রমশ ন্যাটো সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
জাভান দাবি করেছে, কোভিড লকডাউনের সময় ‘কিছুসংখ্যক হাই স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবসায় যুক্ত হন। তাদের পেজগুলো জনপ্রিয় হওয়ার কারণে প্রচুর বিজ্ঞাপন পান এবং আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করেন। তারা তাদের পরিবারের আর্থিক সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন। এখন তারা আরও কর্তৃত্ব নিয়ে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন এবং আরও স্বাধীন হয়ে উঠেছেন।’
রক্ষণশীলদের মতে, পশ্চিমা ইন্টারনেট ইরানের যুবাদের নৈতিকতাকে বিপথে চালিত করছে। ইরানওয়্যারের কাছে ইমাম সাদিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ সাদেগ কুশাকি দাবি করেন, ‘বিক্ষোভকারীদের একমাত্র দাবি ছিল সুইমিং পুল, হিজাব অপসারণ ও ছেলে-মেয়েদের একসঙ্গে পার্টির স্বাধীনতা।’
পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য হামিদ রাসাই সংবাদমাধ্যমে প্রশ্ন রেখে বলেছেন, “গুটিকয়েক ব্যক্তি রাস্তায় মাথার স্কার্ফ নেড়েছে তাদের চাওয়া কী বলে আপনাদের মনে হয়? তারা একমাত্র যে ‘স্বাধীনতা’ চায় তা হলো প্রতি রাতে ভিন্ন কারও সঙ্গে কাটানো ও পশুর মতো আচরণ করা।”
শাসকদের কট্টর বিরোধী পক্ষ ও আবেগপ্রবণ আন্দোলনকারীদের মধ্যে দেশটির বিচার বিভাগ একটি ভ্রান্তিকর পার্থক্য তৈরি করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষামন্ত্রী ইউসেফ নুরি নিশ্চিত করেছেন, কিছু স্কুলছাত্রকে সত্যিই আটক করা হয়েছে এবং তাদের ‘মনস্তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠানে’ রাখা হয়েছে।
নুরি বলেন, “প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের ‘অসামাজিক’ আচরণ প্রতিরোধ করে তাদের মন সংস্কার ও পুনর্শিক্ষিত করা।”
এ সমাধান আদতে নৈতিকতা পুলিশের পুনর্শিক্ষা কর্যক্রম থেকে আলাদা কিছু নয়।
গ্রেপ্তার শিশুদের বাবা-মাকেও আটক করা হচ্ছে। অনেককে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ ‘যথাযথ’ আচরণের শর্ত সাপেক্ষে জামিন দেয়া হচ্ছে।
ইরানে নির্বাচনে টানা হার ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরমাণু চুক্তি-সংক্রান্ত বিশ্বাসঘাতকতার কারণে দেশটির সংস্কারপন্থিরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। তাদের অভিযোগ, রক্ষণশীলরা এখন তাদের বোনা তিক্ততার ফসল কাটছে।
পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, মিডিয়াকে শৃঙ্খলিত করা ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বন্দি করার পর তরুণ ইরানিদের নিজেদের মুক্তির জন্য অন্য পথ খুঁজতে হয়েছে।
সংস্কারপন্থি পত্রিকা ইতেমাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস হজরাতি ১৩ অক্টোবর এক খোলা চিঠিতে লিখেছেন, ‘বিবিসি ও ইরান ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রতিটি ইরানি ... ইরানের রাষ্ট্রীয় সেন্সরের কারণে যুক্ত হয়েছেন।’
ইন্টারনেট যেভাবে ইরানি যুবাদের পালটে ফেলছে ও একটি অপূরণীয় জেনারেশন গ্যাপ তৈরি করছে তা উল্লেখ করে পত্রিকাটি একটি সতর্কতা বার্তা আবার ছাপিয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘তাদের মা-বাবার ভূমিকা খুবই দুর্বল। শিক্ষক ও মা-বাবার মতো ঐতিহ্যগত শিক্ষাব্যবস্থা, হাই স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তাদের আনুগত্য দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।’
প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে ঘিরে রয়েছে মশাদ শহরের রাজনৈতিক গোষ্ঠী, যাদের মধ্যে আছেন তার শ্বশুর আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আহমদ আলামলহোদা।
তারাই মূলত নৈতিকতা পুলিশকে হিজাব পরানোর জন্য চাপ বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ইরানের রাজনৈতিক শ্রেণি যে আঘাতের সম্মুখীন হয়েছে তাতে সাড়া দেয়ার দক্ষতা তাদের আছে কি না, তা পরিষ্কার নয়। তবে এ মুহূর্তের জন্য, প্রমাণ ও অতীতের ঘটনাবলির বিবেচনায় বলা যায়, যারা বহিরাগতদের দোষারোপ ও দমন-পীড়নের পক্ষে তারাই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।