ইরানে নারীর পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন ধীরে ধীরে দেশটির শাসকগোষ্ঠীর পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। পুলিশি হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর নারীদের নেতৃত্বে চলা বিক্ষোভে সবশেষ শ্রমিক সংগঠনগুলোও যোগ দিতে শুরু করেছে।
এর আগে বিক্ষোভে যোগ দেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। স্কুলছাত্রীরাও হিজাব খুলে যোগ দিয়েছে প্রতিবাদে। ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভে নিহত হয়েছেন অন্তত ১৮৫ জন, যাদের মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরের সংখ্যা ১৯।
প্রতিবাদকারীদের দমনে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ব্লকসহ ইন্টারনেটে ব্যাপক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবে এর পরও থামছে না বিক্ষোভ-সহিংসতা।
দেশটির দক্ষিণের বুশেহের প্রদেশের তেল পরিশোধন কেন্দ্র বুশেহের পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানির (বিইউপিসি) শ্রমিকরা সোমবার বিক্ষোভে সংহতি জানিয়ে ধর্মঘট শুরু করেন। রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে ‘খামিনির মৃত্যু চাই’ স্লোগান দিয়ে মিছিলও করেন শ্রমিকরা।
বুশেহের পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানির (বিইউপিসি) যাত্রা শুরু ২০১৫ সালে। দেশটির বৃহত্তম পেট্রোকেমিক্যাল প্ল্যান্ট হিসেবে পরিচিত এই বিইউপিসির বছরে ৬৬ লাখ টন পেট্রোকেমিক্যাল (অপরিশোধিত তেলের উপজাত) উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।
ইরানে চলমান বিক্ষোভে এর আগে আরও কয়েকটি খাতের শ্রমিকরা সংহতি জানিয়েছেন। তবে এই প্রথম তেল শ্রমিকরা সরাসরি ধর্মঘট শুরু করলেন।
ইরানের অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করে পাওয়া অর্থ দেশটির জিডিপির ১৮ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে সরকারি রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ এসেছে এই দুই খাত থেকে। এ কারণে তেল শ্রমিকদের ধর্মঘট পেট্রোলিয়ামনির্ভর দেশটির দুর্বল অর্থনীতিকে আরও বিপর্যস্ত করে দিতে পারে।
চলমান বিক্ষোভ ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ দমনপীড়ন অব্যাহত রাখলে ধর্মঘটে নামার হুঁশিয়ারি কয়েক দিন আগেই দিয়েছিল ইরানের তেল শ্রমিকদের সংগঠন।
তেল কোম্পানিতে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের সংগঠন সোমবার বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা আগে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলাম, আমাদের সচেতন এবং সাহসী কর্মীরা জনগণের ওপর দমনপীড়ন ও হত্যার মুখে নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকবেন না। তারা জনগণের সঙ্গে ঐক্যৈবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন।
‘এটি শুরু হয়ে গেছে। আমরা সারা দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব।’
এই বিক্ষোভে এরই মধ্যে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। তাদের ডাকা ধর্মঘটে ইরানের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে দোকানপাট, ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
এর আগে ২০১৯ সালে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হলে ইরানের কর্তৃপক্ষ বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সহায়তায় কঠোরভাবে তা দমন করে। সে সময় ১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়।
فوریکارگران پروژهای نفت در تداوم خیزش سراسری دست به اعتراض زدندصبح امروز دوشنبه ۱۸ مهرماه کارگران پروژهای شاغل در پتروشیمی بوشهر واقع در عسلویه از ساعت اولیه صبح و قبل از شروع کار دست به تجمع و سردادن شعار زدند.#مهسا_امینی #سایبری_کصکش pic.twitter.com/vtNiWAy6QI
— Majid.A (@AlibakhshiMaji3) October 10, 2022এরপর শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বড় আকারের কোনো বিক্ষোভের ঘটনা না ঘটলেও সাম্প্রতিক সময়ে ইরানে জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়া এবং সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
মাহসা ইস্যুতে প্রথম দুই সপ্তাহ ইরানের তেল শ্রমিকরা নিশ্চুপ থাকলেও পরে তারাও রাস্তায় নামার ইঙ্গিত দেন।
রেডিও ফারদাকে গত ২৬ সেপ্টেম্বর তেল শ্রমিকদের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমরা নারীর বিরুদ্ধে সংগঠিত ও দৈনন্দিন সহিংসতার বিরুদ্ধে এবং সমাজে বিস্তৃত দারিদ্র্য ও দোজখের পরিবেশের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামকে সমর্থন করি।’
ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তুমুল বিক্ষোভ
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চলমান বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের জন্য আশা হয়ে দাঁড়াতে পারে আন্দোলনে দেশটির সংগঠিত শ্রমিকদের সংহতি। কারণ এতদিন যারা রাস্তায় প্রতিবাদমুখর ছিলেন তাদের বেশির ভাগই তরুণ ও বেকার। তাদের সঙ্গে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো যুক্ত হলে আন্দোলন নতুন মাত্রা পাবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা ভিডিওতে দেখা গেছে, কর্তৃপক্ষের কঠোর অবস্থান উপেক্ষা করে তেহরানসহ ইরানের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ চলছে। হাই স্কুলের শত শত ছাত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রোববারও সরাসরি গুলি, কাঁদানে গ্যাস উপেক্ষা করে রাস্তার প্রতিবাদে যোগ দেন। কয়েকটি ভিডিওতে দক্ষিণ তেহরানের কয়েকটি রাস্তা অবরোধ করতেও দেখা গেছে।
This is today in Azad university and the student wrote only one sentence: “Be our voice”.This is a message to the free world.Iranians are getting killed for protesting over the brutal death of my #MahsaAmini but as you see they are not giving up.#مهسا_امینی pic.twitter.com/qm0AGEZREb
— Masih Alinejad 🏳️ (@AlinejadMasih) October 9, 2022তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এসব ভিডিও নিরপেক্ষভাবে যাচাই করতে পারেনি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো।
ইরানি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা বিক্ষোভ দমনে তাজা গুলি ব্যবহার করছে। কয়েকটি ভিডিওতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সরাসরি গুলি ছুড়তে দেখা যায়।
ইরান কর্তৃপক্ষ বিক্ষোভের ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য শত্রু দেশের চক্রান্ত হিসেবে অভিহিত করছে। হতাহতের ঘটনার জন্য ভিন্নমতাবলম্বী সশস্ত্র গোষ্ঠীকে দায়ী করেছে তারা। দেশটির কর্তৃপক্ষ বলছে, এখন পর্যন্ত চলা বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর ২০ সদস্য নিহত হয়েছেন।
কুর্দি নারী মাহসা আমিনিকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের ‘নৈতিকতা পুলিশ’ গ্রেপ্তার করে। ইরানের দক্ষিণাঞ্চল থেকে তেহরানে ঘুরতে আসা মাহসাকে একটি মেট্রো স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সঠিকভাবে হিজাব করেননি।
পুলিশ হেফাজতে থাকার সময়েই মাহসা অসুস্থ হয়ে পড়েন, এরপর তিনি কোমায় চলে যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। পুলিশ মাহসাকে হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরিবারের অভিযোগ গ্রেপ্তারের পর তাকে পেটানো হয়।
মাহসার মৃত্যুর পর রাস্তায় বিক্ষোভের পাশাপাশি ফেসবুক ও টুইটারে #mahsaamini এবং #Mahsa_Amini হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে চলছে প্রতিবাদ।
মাহসা আমিনির মৃত্যুর সঙ্গে এক পুলিশ কর্মকর্তার হাতে বালুচ কিশোরীর ধর্ষণের ঘটনা ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশের চাবাহার শহরের পুলিশ প্রধানের হাতে ওই কিশোরী ধর্ষণের প্রতিবাদ জানাতে সেখানেও চলছে প্রবল বিক্ষোভ। কেবল ওই প্রদেশেই এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৯০ জন।
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পরই নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়। দেশটির ধর্মীয় শাসকদের কাছে নারীদের জন্য এটি ‘অতিক্রম-অযোগ্য সীমারেখা’। বাধ্যতামূলক এই পোশাকবিধি মুসলিম নারীসহ ইরানের সব জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মের নারীদের জন্য প্রযোজ্য।
হিজাব আইন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগের জন্য চলতি বছরের ৫ জুলাই ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি একটি আদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে ‘সঠিক নিয়মে’ পোশাকবিধি অনুসরণ না করা নারীদের সরকারি সব অফিস, ব্যাংক এবং গণপরিবহনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ ঘটনায় গত জুলাইয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #no2hijab হ্যাশট্যাগ দিয়ে শুরু হয় প্রতিবাদ। দেশটির নারী অধিকারকর্মীরা ১২ জুলাই সরকারঘোষিত জাতীয় হিজাব ও সতীত্ব দিবসে প্রকাশ্যে তাদের বোরকা ও হিজাব সরানোর ভিডিও পোস্ট করেন।