ইরানে ‘সঠিকভাবে’ হিজাব না করার অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর পুলিশি হেফাজতে মারা যাওয়া মাহসা আমিনি এখন গোটা ইরানে নারীর পোশাকের স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।
কুর্দি নারী মাহসাকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের ‘নৈতিকতা পুলিশ’ গ্রেপ্তার করে। ইরানের পশ্চিমাঞ্চল থেকে তেহরানে ঘুরতে আসা মাহসাকে একটি মেট্রো স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সঠিকভাবে হিজাব করেননি।
পুলিশ হেফাজতে থাকার সময়ে মাহসা অসুস্থ হয়ে পড়েন, এরপর তিনি কোমায় চলে যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। তার পরিবার ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন শুরু থেকেই দাবি করছে, গ্রেপ্তারের সময় মাহসার মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে লাঠির আঘাত করে পুলিশ। এ কারণেই পরে তিনি চেতনা হারিয়ে কোমায় চলে যান।
তবে ইরান সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, মাহসার মৃত্যুর কারণ ‘অসুস্থতাজনিত’।
দেশটির ফরেনসিক চিকিৎসকদের সংগঠন শুক্রবার এক বিবৃতিতে দাবি করে মাহসা আমিনির মৃত্যুর কারণ আঘাতজনিত নয়, বরং বিশেষ কোনো শারীরিক অসুস্থতায় তিনি মারা যান। তবে ওই বিবৃতিতে মাহসাকে আঘাতের তথ্য অস্বীকার করা হয়নি।
মাহসা আমিনির মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে ইরান
আনুষ্ঠানিক মেডিক্যাল প্রতিবেদনের বরাতে ইরানের ফরেনসিক মেডিসিন অর্গানাইজেশন বলছে, ‘মাথা ও শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে আঘাতের কারণে মাহসা আমিনির মৃত্যু হয়নি। অচেতন হয়ে পড়ার সময়ে কয়েক মিনিট মাহসার হৃৎযন্ত্র ও ফুসফুস অকার্যকর হয়ে পড়ে। এতে তিনি গুরুতর হাইপোক্সিয়ায় (অক্সিজেন ঘাটতি) আক্রান্ত হন। পরে হৃৎযন্ত্র ও ফুসফুস সচল হলেও তার মস্তিষ্ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
মাহসাকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের একটি মেট্রো স্টেশন থেকে গ্রেপ্তারের সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন তার ভাই কিয়ারশ আমিনি। কুর্দি তরুণীকে গ্রেপ্তার করা ‘নৈতিকতা পুলিশ’ এর দলটিতে কারা ছিলেন সে বিষয়ে ইরান সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। তবে একটি হ্যাকার গ্রুপের দাবি, তারা ওই দলের চার সদস্যকে চিহ্নিত করতে পেরেছে।
ব্যাকডোর (3ackd0or) নামের হ্যাকার গ্রুপটি এই চারজনের বিষয়ে ইরান ইন্টারন্যাশনাল সংবাদমাধ্যমকে বিস্তারিত নথি সরবরাহ করেছে। তবে এ বিষয়টি স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি ইরান ইন্টারন্যাশনাল।
دو هفته بعد ازکشته شدن مهسا امینی در بازداشتگاه گشت ارشاد، گروه هکری بکدور (3ackd0or) اطلاعات کامل فرمانده تیم بازداشت کننده مهسا امینی و یک مامور مرد و دو مامور زن عضو این تیم را در اختیار ایران اینترنشنال قرار داده استگزارش مجتبی پورمحسن، ایران اینترنشنال pic.twitter.com/0KOqeTDtvC
— ايران اينترنشنال (@IranIntl) October 2, 2022ব্যাকডোরের তথ্য অনুযায়ী, গ্রেপ্তারের পর মাহসাকে একটি পুলিশ ভ্যানে তুলে তেহরানের ভোজারা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ভ্যানে তোলার আগে অন্তত একবার তার মাথায় সজোরে লাঠির আঘাত করা হয়, ফলে পুলিশকেন্দ্রে নেয়ার পর তিনি চেতনা হারান।
নৈতিকতা পুলিশের ৪ সদস্যের দলটির নেতৃত্বে ছিলেন দলের ক্যাপ্টেন এনায়াতুল্লাহ রাফি
হ্যাকার গ্রুপ ব্যাকডোরের দাবি অনুযায়ী, নৈতিকতা পুলিশের চার সদস্যের একটি দল মাহসাকে গ্রেপ্তার করে। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন দলের ক্যাপ্টেন এনায়াতুল্লাহ রাফি। ৫২ বছর বয়সী রাফির বাড়ি উত্তর-পশ্চিম জাঞ্জান প্রদেশের খোদাবন্দেহ শহরে।
সার্জেন্ট আলি খোশনামভান্দ
এই দলের আরেক পুরুষ সদস্য ছিলেন সার্জেন্ট আলি খোশনামভান্দ। ২৭ বছর বয়সী খোশনামভান্দ পশ্চিম ইরানের লোরেস্তান প্রদেশের কৌহদশত জেলার খুশনামভান্দ গ্রামের বাসিন্দা।
মাহসার পোশাককে ‘অনুপযুক্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করেন পারাসতু সাফারি
মাহসাকে গ্রেপ্তার করা দলটির দুই নারী সদস্যের একজন হলেন পারাসতু সাফারি। ৩৬ বছর বয়সী এই নারীই মাহসার পোশাককে ‘অনুপযুক্ত’ সিদ্ধান্ত দিয়ে তাকে ‘ইসলামিক ড্রেস কোডের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে’ পাঠানোর প্ররোচনা দেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সাফারির বাড়ি দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় কেরমানশাহ শহরে।
নৈতিকতা পুলিশ দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ফাতিমা ঘোরবান-হোসেইনি
এ ছাড়া দলের আরেক নারী সদস্যের নাম ফাতিমা ঘোরবান-হোসেইনি। তেহরানেই জন্ম ও বড় হয়েছেন ২৭ বছর বয়সী এই নারী।
মাহসাকে গ্রেপ্তারের সময় ঘটনাস্থলে থাকা তার ভাই কিয়ারশ গত মাসে ইরানওয়্যারকে জানান, তাদের পরিবার ইরানের কুর্দিস্তান প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর সাকেজ থেকে রাজধানী তেহরানে ঘুরতে এসেছিল। শহীদ হাঘানি এক্সপ্রেসওয়ের প্রবেশপথে ১৩ সেপ্টেম্বর ভোর সাড়ে ৬টার দিকে নৈতিকতা পুলিশের টহল ভ্যান তাদের গতিরোধ করে।
পুলিশ মাহসাকে জোর করে ভ্যানে তুলে নেয়। তার ভাই এ সময় বাধা দিয়েও ব্যর্থ হন। নৈতিকতা পুলিশের দলটি যাওয়ার সময় জানায়, মাহসাকে তারা নিজেদের স্টেশনে নিয়ে যাচ্ছে এবং ১ ঘণ্টার ‘শিক্ষা সেশন’ শেষে ছেড়ে দেয়া হবে।
পরের ঘটনার বিবরণ দিয়ে কিয়ারশ বলেন, ‘আমি ওদের (নৈতিকতা পুলিশ) ভবনের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আমার সঙ্গে আরও অনেকে ছিলেন। এ সময় হঠাৎ ভেতর থেকে চিৎকার শুনতে পাই।
‘আমরা সবাই দরজায় ধাক্কা দিতে থাকি। হঠাৎ পুলিশ সদস্যরা ভবন থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের লাঠিপেটা এবং টিয়ার শেল ছুড়তে শুরু করে। আঘাতে আমার সারা শরীর কালো আর নীল হয়ে গিয়েছিল। কাঁদানে গ্যাসের কারণে চোখ জ্বলছিল। এর ৫ মিনিট পর একটি অ্যাম্বুলেন্স ভবনটি থেকে বেরিয়ে যায়।’
মাহসার মৃত্যু বিক্ষোভ ছড়িয়ে দিয়েছে ইরানজুড়ে
কিয়ারশ বলেন, ‘এ সময় বন্দি অনেক নারী ছুটে বেরিয়ে আসেন। তারা বলছিলেন ভেতরে কেউ মারা গেছে। আমি তাদের মাহসার ছবি দেখালাম। একজন বললেন, ঘটনাটি ঘটার সময় মাহসা তার পাশে ছিল।
‘আমি হতবাক ও আতঙ্কিত হয়ে যাই। এক পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে। তিনি বললেন, তাদের একজন আহত হয়েছেন। তিনি আসলে মিথ্যা বলছিলেন। আমি তাকে বিশ্বাস করিনি। সেই অ্যাম্বুলেন্সে ছিল মাহসা। আমি ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে গিয়েছি।’
সেদিন রাত সোয়া ৮টার দিকে চিকিৎসকরা মাহসার পরিবারকে জানান, তাকে বাঁচানো যাবে না। তিনি হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। তার হৃৎপিণ্ড সচল থাকলেও মস্তিষ্ক কাজ করছে না। কোমায় চলে যাওয়া মাহসার মৃত্যু হয় ১৬ সেপ্টেম্বর।
মাহসার এবারের জন্মদিনে কবরে ছিল শোকার্তদের ফুল আর কেক (ডানে)
১৯৯৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া মাহসার পুরো নাম জিনা মাহসা আমিনি।
ইরান সরকারের অভিযোগ, মাহসা কুর্দি বিদ্রোহী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে এ অভিযোগকে সরকারের প্রোপাগান্ডা হিসেবে দাবি করেছে তার পরিবার।
মাহসা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না জানিয়ে তার চাচাতো ভাই এরফান মোর্তেজা বলেন, ‘আমার সোজাসাপ্টা উত্তর হলো মাহসা তার ২২ বছরের জীবনে কখনও ইরানের বাইরে পা রাখেনি। সে ছিল মিষ্টি একটি মেয়ে, যার জীবন বলতে ছিল সংগীত, ভ্রমণ, শিল্প সম্পর্কে চিন্তা। মাহসা কোনো রাজনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত ছিল না। তার স্বপ্ন ছিল নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা।’
এরফান মোর্তেজা বলেন, ‘মাহসা বা আমাদের প্রিয় জিনা (ডাকনাম) সব সময় হাসিখুশি, উচ্ছ্বসিত ও প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ ছিল। গান, ঘোরাঘুরি, কুর্দি পোশাক এবং শিল্প খুব পছন্দ করত। আমাদের কোনো আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতদের সঙ্গে ও কখনও দুর্ব্যবহার করেনি।’
‘বাধ্যতামূলক হিজাব আইন ও একদম পছন্দ করত না।’
তেহরানের রাস্তায় হিজাব পুড়িয়ে দিচ্ছেন বিক্ষুব্ধ নারীরা
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পরই নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়। ইরানের ধর্মীয় শাসকদের কাছে নারীদের জন্য এটি ‘অতিক্রম-অযোগ্য সীমারেখা’। বাধ্যতামূলক এই পোশাকবিধি মুসলিম নারীসহ ইরানের সব জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মের নারীদের জন্য প্রযোজ্য।
এই পোশাকবিধি অনুযায়ী নারীদের জনসমক্ষে চুল সম্পূর্ণভাবে ঢেকে রাখতে হয় এবং লম্বা, ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হয়।
হিজাব আইন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগের জন্য চলতি বছরের ৫ জুলাই ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি একটি আদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে ‘সঠিক নিয়মে’ পোশাকবিধি অনুসরণ না করা নারীদের সরকারি সব অফিস, ব্যাংক এবং গণপরিবহনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ ঘটনায় গত জুলাইয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #no2hijab হ্যাশট্যাগ দিয়ে শুরু হয় প্রতিবাদ। দেশটির নারী অধিকারকর্মীরা ১২ জুলাই সরকারঘোষিত জাতীয় হিজাব ও সতীত্ব দিবসে প্রকাশ্যে তাদের বোরকা ও হিজাব সরানোর ভিডিও পোস্ট করেন। তাদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সে সময়েও পোস্ট দিয়েছিলেন অসংখ্য ইরানি পুরুষ।
ওই আন্দোলনের রেশ শেষ না হতেই মাহসার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে উত্তাল ইরানে এখন পর্যন্ত নারী-শিশুসহ অন্তত ১৫৪ বিক্ষোভকারী প্রাণ হারিয়েছেন।