ইরানে চলমান বিক্ষোভে নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পুলিশি হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর সঙ্গে এক পুলিশ কর্মকর্তার হাতে বালুচ কিশোরীর ধর্ষণের ঘটনা ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
মাহসার মৃত্যুর পর ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে দেশজুড়ে চলমান বিক্ষোভে নিহত হয়েছেন অন্তত ১৫৪ জন। তাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা অন্তত ৯, প্রতিবাদে অংশ নেয়া বেশ কয়েকজন নারীও প্রাণ হারিয়েছেন।
প্রতিবাদকারীদের দমনে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ব্লকসহ ইন্টারনেটে ব্যাপক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবে এর পরও থামছে না বিক্ষোভ-সহিংসতা।
নারীর পোশাকের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার দাবিতে এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পর ইরানের স্কুলছাত্রীরাও যোগ দিয়েছে প্রতিবাদে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বেশ কয়েকটি ভিডিওতে দেখা যায় স্কুলের ভেতরে ছাত্রীরা মাথার হিজাব খুলে ‘স্বৈরাচারের মৃত্যু চাই’ স্লোগান দিচ্ছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির ছবি পদদলিত করতেও দেখা গেছে। রাস্তার বিক্ষোভেও যোগ দিয়েছে স্কুলছাত্রীরা।
Today in Iran, schoolgirls remove their compulsory hejab and chant “death to the dictator” while stomping on the photos of their rulers pic.twitter.com/ipQPSZhsvC
— Karim Sadjadpour (@ksadjadpour) October 3, 2022চলমান বিক্ষোভে অংশ নেয়া দুই কিশোরীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে ইরানের নৈতিকতা পুলিশের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ১৬ বছর বয়সী সারিনা ইসমাইলজাদেহর মাথায় লাঠির (ব্যাটন) মাথায় আঘাত করা হয়।
ইরানি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রতিবাদী গ্রাফিক ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে
অসলোভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ইরান হিউম্যান রাইটসের (আইএইচআর) সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ইরান বিক্ষোভে নিহত হয়েছেন অন্তত ১৫৪ জন। এর মধ্যে সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশের জাহেদান শহরে সবচেয়ে বেশি ৬৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশের চাবাহার শহরের পুলিশ প্রধানের হাতে এক কিশোরী ধর্ষণের প্রতিবাদ জানাতে জাহেদানে ৩০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার জুমার নামাজের পর শুরু হয় বিক্ষোভ। এতে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালালে বহু মানুষ হতাহত হন। বেলুচ অ্যাক্টিভিস্ট ক্যাম্পেইন সেদিন নিহত ৪১ জনের নাম প্রকাশ করে। তবে পরে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৬৩-তে পৌঁছায় বলে জানিয়েছে আইএইচআর।
জাহেদানে বিক্ষোভের সময় সিস্তান-বেলুচিস্তানে ইসলামী বিপ্লবি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) গোয়েন্দা প্রধান আলী মুসাভিও গুলিবিদ্ধ হন। পরে হাসপাতালে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
হিজাব খুলে ইরানি স্কুলছাত্রীদের প্রতিবাদ
আইএইচআর বলছে, গত সোমবার নিরাপত্তাবাহিনীর গুলিতে ওই প্রদেশে আরও চারজনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেলেও এখনও স্বাধীনভাবে এর সত্যতা যাচাই করা যায়নি।
এসব ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন আইএইচআরের পরিচালক মাহমুদ আমিরি-মোগাদ্দাম। তিনি বলেন, ‘ইরানে, বিশেষ করে জাহেদানে বিক্ষোভকারীদের হত্যা একটি মানবতাবিরোধী অপরাধের সমান। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এটিসহ ইরানের সম্প্রতি অন্য অপরাধগুলোর তদন্ত করা।’
অসলোভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি বলছে, ইরানের ১৭টি প্রদেশে এখন পর্যন্ত প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী রয়েছে অন্তত ৯ জন।
চলমান বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের ‘ইসরায়েলের সেনা’ হিসেবে অভিহিত করছে সরকার ও হিজাবপন্থিরা। এরই মধ্যে তারাও বিক্ষোভ করেছে এবং সেই বিক্ষোভ সরাসরি সম্প্রচার করা হয় ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে।
বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে ইরানের বিভিন্ন প্রদেশে
কুর্দি নারী মাহসা আমিনিকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের ‘নৈতিকতা পুলিশ’ গ্রেপ্তার করে। ইরানের দক্ষিণাঞ্চল থেকে তেহরানে ঘুরতে আসা মাহসাকে একটি মেট্রো স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সঠিকভাবে হিজাব করেননি।
পুলিশ হেফাজতে থাকার সময়েই মাহসা অসুস্থ হয়ে পড়েন, এরপর তিনি কোমায় চলে যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। পুলিশ মাহসাকে হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরিবারের অভিযোগ গ্রেপ্তারের পর তাকে পেটানো হয়।
পুলিশি হেফাজতে মারা যাওয়া মাহসা আমিনি
মাহসার মৃত্যুর পর রাস্তায় বিক্ষোভের পাশাপাশি ফেসবুক ও টুইটারে #mahsaamini এবং #Mahsa_Amini হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে চলছে প্রতিবাদ।
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পরই নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়। দেশটির ধর্মীয় শাসকদের কাছে নারীদের জন্য এটি ‘অতিক্রম-অযোগ্য সীমারেখা’। বাধ্যতামূলক এই পোশাকবিধি মুসলিম নারীসহ ইরানের সব জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মের নারীদের জন্য প্রযোজ্য।
হিজাব আইন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগের জন্য চলতি বছরের ৫ জুলাই ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি একটি আদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে ‘সঠিক নিয়মে’ পোশাকবিধি অনুসরণ না করা নারীদের সরকারি সব অফিস, ব্যাংক এবং গণপরিবহনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ ঘটনায় গত জুলাইয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #no2hijab হ্যাশট্যাগ দিয়ে শুরু হয় প্রতিবাদ। দেশটির নারী অধিকারকর্মীরা ১২ জুলাই সরকারঘোষিত জাতীয় হিজাব ও সতীত্ব দিবসে প্রকাশ্যে তাদের বোরকা ও হিজাব সরানোর ভিডিও পোস্ট করেন।