ফিলিপিন্সে টানা অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও ভয়াবহ বন্যায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় রাস্তাঘাট পানির নিচে, শহরের পর শহর কার্যত অচল। কিন্তু এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাঝেও সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষোভ প্রকৃতির নয়, বরং সরকারের বিরুদ্ধে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে দেশজুড়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, বছরের পর বছর ধরে বিলিয়ন বিলিয়ন পেসো খরচ হলেও সড়ক, বাঁধ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থায় কোনো উন্নয়ন হয়নি। এর পেছনে রয়েছে দুর্নীতি ও ‘ভূতুড়ে প্রকল্প’।
এই পরিস্থিতিতে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে পানিবাহিত রোগের সংক্রমণ। রাজধানীর আশপাশে লেপ্টোসপাইরোসিস নামে এক ধরনের সংক্রমণ বাড়ছে, যা মূলত ইঁদুরের মল থেকে ছড়ায়।
৩৬ বছর বয়সী এক স্কুল শিক্ষিকা, ক্রিসা তলেন্তিনো, প্রতিদিন পানিতে ডুবে যাওয়া রাস্তায় প্যাডেলবোটে করে স্কুলে যান। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক দিন ধরেই বন্যাকে জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছি। কিন্তু এবার আমি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ।’ তিনি অভিযোগ করেন, প্রতি মাসে নিয়ম করে কর দিলেও সেই টাকা জনগণের কাজে না লেগে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের বিলাসবহুল জীবনযাপনে ব্যয় হচ্ছে।
এই ক্ষোভ শুধু একজনের নয়, এখন তা সারাদেশজুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মানুষ প্রশ্ন তুলছে, এত অর্থ খরচ সত্ত্বেও কেন প্রতিবছর একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়?
দেশটির প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ ‘বংবং’ মার্কোস জুনিয়র নিজেও দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেননি। একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে তিনি দেখেন, সেটি আদৌ নির্মিতই হয়নি। পরে সাংবাদিকদের তিনি জানান, একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে, যাতে ধরা পড়বে কারা কারা এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত এবং কত টাকা চুরি হয়েছে।
সরকারের পরিকল্পনা বিভাগের এক মন্ত্রী জানিয়েছেন, শুধু বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থের প্রায় ৭০ শতাংশ দুর্নীতির কারণে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে বড় অঘটন ঘটে গেছে সংসদেও। দুর্নীতির দায় না মেনেও স্পিকারের পদত্যাগ এসেছে, যা আরও সন্দেহ বাড়িয়েছে। অন্যদিকে, সিনেটের এক নেতাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, কারণ ২০২২ সালের নির্বাচনী প্রচারে তাকে অনুদান দিয়েছিলেন এমন এক ঠিকাদার, যিনি একটি সরকারি প্রকল্পের টেন্ডার পেয়েছিলেন। এটি ফিলিপিন্সের নির্বাচনী আইনে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ।
সরকারবিরোধী ক্ষোভ এখন ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইনেও। টিকটক, ফেসবুক ও এক্স-এ চলছে তীব্র সমালোচনা। জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের সন্তানদের বিলাসী জীবন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
‘নেপো বেবি’ হ্যাশট্যাগে চিহ্নিত করা হচ্ছে সেসব তরুণ-তরুণীকে, যারা সামাজিক মাধ্যমে দামি ডিজাইনের পোশাক, ব্যাগ বা গাড়ির ছবি দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষের মতে, এসব বিলাসিতা সম্ভব হয়েছে করদাতাদের টাকায়।
সম্প্রতি এক সাবেক সংসদ সদস্যের মেয়ে ফ্যাশন ব্র্যান্ড ফেন্ডি ও ডিওরের পোশাক পরে এবং দামি হারমেস ব্যাগ হাতে ছবি দিলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। এই ঘটনার পর অনেকেই তাদের অ্যাকাউন্টের মন্তব্য অপশন বন্ধ করে দেন বা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে দেন।
এদিকে, ‘ক্রিয়েটরস অ্যাগেইনস্ট করাপশন’ নামে একটি নতুন সামাজিক উদ্যোগ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন জনপ্রিয় অনলাইন কনটেন্ট নির্মাতা এতে যুক্ত হয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের প্রচার চলবে আরও বড় পরিসরে।
বিক্ষোভের ডাকও এসেছে। আগামী ২১ সেপ্টেম্বর, রোববার রাজধানী ম্যানিলাসহ দেশের বড় বড় শহরে জনসমাবেশের প্রস্তুতি চলছে। এই তারিখটিকে প্রতীকী হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে, কারণ ১৯৭২ সালের এই দিনেই ফার্দিনান্দ মার্কোস সিনিয়র সামরিক শাসন জারি করেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট মার্কোস জুনিয়রের বাবা ছিলেন সেই সময়কার নেতা, যাকে ১৯৮৬ সালে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে হয়। এবার ইতিহাস যেন নিজেকে পুনরাবৃত্ত করছে।
বলা হচ্ছে, নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার সাম্প্রতিক জনআন্দোলনের মতো ফিলিপিন্সেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে সরকারি প্রকৌশলীদের জনসমক্ষে হেনস্তার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে নির্মাণ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মীকে সরকারি ইউনিফর্ম না পরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে জনতা তাদের সহজে চিনে ফেলতে না পারে।