নারীর পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে টানা বিক্ষোভে উত্তাল ইরান। পুলিশি হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে দেশজুড়ে চলমান বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৭৬ জন।
বিক্ষোভ দমনে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ ব্লকসহ ইন্টারনেটে ব্যাপক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবে এর পরও একের পর এক শহরে ছড়িয়ে পড়ছে সহিংস প্রতিবাদ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক নিবন্ধে এই বিক্ষোভের সম্ভাব্য পরিণতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ব্লুমবার্গের অপিনিয়ন কলামিস্ট ববি ঘোষের নিবন্ধটি ভাষান্তর করা হয়েছে নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য।
পুলিশি হেফাজতে কুর্দি নারী মাহসা আমিনির মৃত্যু কেন্দ্র করে ইরানে টানা বিক্ষোভ তৃতীয় সপ্তাহের দিকে গড়াচ্ছে। সময় যতই যাচ্ছে, ততই দমন-পীড়ন তীব্র করছে শাসকগোষ্ঠী।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরাবদুল্লাহিয়ান পশ্চিমা প্রতিপক্ষদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘ইরানে বড় কোনো ঘটনা ঘটছে না।’
তবে ইরান যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ করে শাসকগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান বর্বরতাকে চাপা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের নেতৃস্থানীয় শক্তিগুলো ক্রমাগত এর নিন্দা জানাচ্ছে এবং কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, বিক্ষোভকারীরা ইরানের অভ্যন্তরের অন্য গোষ্ঠীগুলোকে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে রাজি করাতে পারবে কি না।
চোখের সামনে ঘটা প্রমাণগুলো অস্বীকারে ইরানিদের রাজি করাতে না পেরে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রটির শাসকেরা এখন প্রোপাগান্ডার পথ বেছে নিচ্ছে। তারা প্রচার করছে বিক্ষোভগুলো নিছক ‘দাঙ্গা’, ইরানের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা দুর্বল করে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় এগুলো ঘটানো হচ্ছে।
তবে ইরানি জনতা বোকা নয়। যোগাযোগমাধ্যম ব্ল্যাকআউটকে ফাঁকি দিয়ে তারা অব্যাহত বিক্ষোভের কথা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। গোটা বিশ্ব জানে, মাহসা আমিনির হেফাজতে মৃত্যুতে প্রতিবাদে প্রথম যারা রাস্তায় নেমেছিলেন তারা এখন ইসলামি প্রজাতন্ত্রটির ডালপালা ছেঁটে, এমনকি শিকড় উপড়ে ফেলার আহ্বান জানাচ্ছেন।
বিক্ষোভে তাদের স্লোগান শুধু প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির বিরুদ্ধে নয়, দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনি এবং তার ছেলে মোজতবাও এখন ক্ষোভের লক্ষ্য। মোজতবাকে অনেকেই পর্দার নেপথ্যের শক্তি বলে মনে করেন।
আশঙ্কা ছিল, রাশিয়া ও ইউক্রেন সংঘাতের কারণে ইরানের দিকে বিশ্বের মনোযোগ নাও পড়তে পারে। তবে সেটি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। পশ্চিমা নেতারা তেহরানের শাসনব্যবস্থাকে চেপে ধরেছেন।
ক্র্যাকডাউনে জড়িত দেশটির নৈতিকতা পুলিশ এবং কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। ইরানিদের ইন্টারনেট পরিষেবায় সাহায্য করতে বাইডেন প্রশাসন ইলন মাস্কের স্টারলিংকের মতো সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছে।
তবে ইরানের শাসকগোষ্ঠী প্রচলিত হাতিয়ারের ওপর নির্ভরতা যদি হারিয়েও ফেলে, তার পরও তাদের দমন-পীড়নের ভয়ংকর ব্যবস্থাগুলো বেশ নির্ভরযোগ্য। নিয়মিত পুলিশ এবং বাসিজ মিলিশিয়া থেকে শুরু করে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের প্রতিবাদ আন্দোলন দমনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তাদের হাতে ২০১৯ সালে এক হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান, এর মাধ্যমে সে বছর তুমুল বিক্ষোভ দমন করা হয়।
আর সেটা ঘটেছিল কথিত মধ্যপন্থি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সময়ে। এবার বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট রাইসির কাছ থেকে আরও বেশি নিষ্ঠুরতার শিকার হতে পারেন। রাইসি এর আগে বিচারক থাকার সময়ে অসংখ্য মানুষকে ফাঁসিতে ঝোলানোর রায় দিয়েছেন।
প্রতিবাদ এগিয়ে নিতে বিক্ষোভকারীদের আন্তর্জাতিক মনোযোগের চেয়েও বেশি প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ সমর্থন। এই সমর্থন রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার ভেতর এবং বাইরে- দুই দিক থেকেই পেতে হবে।
রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার ভেতর থেকে সমর্থন পাওয়ার বিষয়টি অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। অন্তত স্বল্প সময়ের মধ্যে শাসনব্যবস্থায় ফাটল ধরার কোনো লক্ষণ নেই। তথাকথিত মধ্যপন্থি রুহানি এবং তার সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাওয়াদ জারিফের মতো ব্যক্তিদের বেশির ভাগই দুই সপ্তাহ ধরে নিশ্চুপ।
দেশটির কয়েক ডজন গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহর (শীর্ষস্থানীয় ধর্মীয় নেতা) মধ্যে কেবল হোসেইন নুরি হামাদানি মৃদু ভাষায় সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, সরকারকে উচিত জনগণের দাবির কথা শোনা।
অন্যদিকে বিচার বিভাগের প্রধান গোলাম-হোসেন মহসেনি এজেই সতর্ক করে বলেছেন, যেসব জনব্যক্তিত্ব বিক্ষোভকে সমর্থন করবেন তাদের অবশ্যই সরকারি সম্পত্তি বিনষ্টের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
আরব বসন্তের সময় তিউনিসিয়া ও মিসরের মতো ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীও বিক্ষোভকারীদের প্রতি ন্যূনতম সহানুভূতি দেখিয়েছে। বিক্ষোভকারীদের দমনের পাশাপাশি তারা শাসকগোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে পাল্টা বিক্ষোভের মঞ্চায়ন করছে। নিজস্ব মিডিয়া আউটলেট ব্যবহার করে সরকারপন্থি সেই বিক্ষোভ প্রচারও করা হয়।
চলমান বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের জন্য আশা হয়ে দাঁড়াতে পারে আন্দোলনে দেশটির সংগঠিত শ্রমিকদের সংহতি। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির মধ্যে বেতন বাড়ানোর দাবিতে বেশ কয়েকটি শ্রমিক ইউনিয়ন গত দুই বছরে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। তারা এখনও নারীদের নেতৃত্বে চলমান বিক্ষোভে যোগ দেয়নি।
শিক্ষকদের একটি ইউনিয়ন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে, তবে তার প্রভাব খুব একটা পড়েনি। ইউনিয়নগুলোর সাড়া না পাওয়ার কারণ হতে পারে তারা আগের আন্দোলনের ব্যর্থতার জন্য নিরাশায় ভুগছে। এখন যারা রাস্তায় প্রতিবাদমুখর, তাদের বেশির ভাগ তরুণ ও বেকার। এই বিক্ষোভকারীদের সাফল্যের সম্ভাবনা নিয়েও ইউনিয়নগুলো সন্দিহান।
রাইসি এবং খামেনির সঙ্গে মতভেদ আছে শাসকগোষ্ঠীর ভেতরের এমন নেতারাও একইভাবে অপেক্ষা করছেন। তারা দেখতে চান, আগের বিক্ষোভকারীদের চেয়ে এবারের আন্দোলনকারীরা রাস্তায় বেশি দিন টিকে থাকার শক্তি রাখেন কি না।
ইরানের অভিজাত শ্রেণির মধ্যে সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বিভেদ দেখা দিয়েছিল ২০০৯ সালে। বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রতিবাদে ‘গ্রিন মুভমেন্ট’ নামে দেশব্যাপী বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়। ওই আন্দোলন ব্যাপক জনসমর্থন পেলেও নিরাপত্তা বাহিনী শেষ পর্যন্ত দেশটির সর্বোচ্চ নেতার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিক্ষোভ দমন করে।
সেবারও প্রাণ হারান বহু মানুষ। আন্দোলনের নেতাদের গৃহবন্দি করা হয় এবং সেই বন্দিদশা আর শেষ হয়নি।
আরব বসন্তের সময়ের মতোই ইরানের বর্তমান বিক্ষোভ নেতৃত্বহীন। ফলে শাসকগোষ্ঠী কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে এটি দমনের সুযোগ পাচ্ছে না।
তবে নেতৃত্বহীন বিক্ষোভের আরেকটি দিক হলো, এখানে এমন কোনো গ্রুপ নেই যারা আরও মানুষকে যোগ দেয়ার আহ্বান জানাতে পারে। এমন কেউ নেই যারা বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও কৌশলের সমন্বয় করতে পারে। স্বতঃস্ফূর্ততা একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হতে পারে, তবে একে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখা কঠিন।
বিক্ষোভকারীদের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো, নিরাপত্তা বাহিনীর বন্দুক ও গুলির মুখেও নিজেদের সাহস ধরে রাখা এবং রাস্তায় টিকে থাকা। সেই সঙ্গে তারা প্রার্থনা করতে পারেন, এই অনমনীয় দৃঢ়তা শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকেও যুক্ত হতে উৎসাহিত করবে। এরপর শাসকগোষ্ঠীর ভেতর থেকেই তাদের পক্ষে সরব হবেন অনেকে।
এমন ঘটনা ঘটাতে মহাকাব্যিক সহ্যসীমার প্রয়োজন পড়বে। সেই ঘটনার দৃশ্যায়ন হবে নির্মম, কিন্তু বিশ্ব তা থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখতে পারবে না।