ইরানের নৈতিকতা পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় ২২ বছর বয়সী মাহসা আমিনির মৃত্যুতে প্রতিবাদ চলছে রাজধানী তেহরানসহ ইরানজুড়ে।
দেশটির কঠোর পোশাকবিধি ও নৈতিকতা পুলিশের বিরুদ্ধে অনেক নারী তাদের হিজাব (মাথার স্কার্ফ) পুড়িয়েছে। নারীদের সঙ্গে পুরুষরাও আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন, এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে মারা যাওয়া সবাই পুরুষ।
একজন পথচারী নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন ইরানের নৈতিকতা পুলিশের সদস্যরা
কারা এই নৈতিকতা পুলিশ?
যেই নৈতিকতা পুলিশ নিয়ে ইরানে বিতর্ক, দেশটিতে তাদের বলা হয় গাশত-ই এরশাদ (গাইডেন্স পেট্রল)। এটি পুলিশেরই একটি বিশেষ ইউনিট, যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ইসলামিক নৈতিকতার সম্মান নিশ্চিত করার এবং পোশাকবিধি অনুসরণ না করা ব্যক্তিদের আটক করার।
২০০৫ সালে পুলিশের এই বিশেষায়িত বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয়।
নারীর পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল ইরান
শরিয়ার ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তৈরি করা আইনের অধীনে একজন নারীকে তাদের চুল ঢেকে (হিজাব বা মাথার স্কার্ফ দিয়ে) রাখতে হয় এবং লম্বা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হয়। আর তারই বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় নৈতিকতা পুলিশের ওপর।
১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের নৈতিকতা পুলিশ যখন তাকে গ্রেপ্তার করেছিল তখন আমিনির মাথার স্কার্ফের নিচে কিছু চুল দৃশ্যমান ছিল। পরে তাকে আটক করা হলে সেখান থেকে তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে ৩ দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকার পর তিনি মারা যান।
অভিযোগ রয়েছে যে নৈতিকতা পুলিশ তাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে, যদিও পুলিশ তা অস্বীকার করেছে।
মাহসার মৃত্যুর ঘটনায় আন্দোলনে শামিল হচ্ছেন ইরানের পুরুষরাও
এক সদস্যের বয়ানে নৈতিকতা পুলিশ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নৈতিকতা পুলিশ বিবিসিকে বলেছেন, ‘তারা (কর্তৃপক্ষ) আমাদের বলেছে, আমরা নৈতিকতা পুলিশ ইউনিটের জন্য কাজ করছি, আমরা নারীদের সুরক্ষার জন্য কাজ করছি। যদি তারা (নারী) সঠিকভাবে পোশাক না পরে, তাহলে পুরুষরা উত্তেজিত হতে পারে এবং তাদের ক্ষতি করতে পারে।’
তিনি বলেছিলেন, তিনি যেই দলে কাজ করতেন সেখানে ৬ জন ছিলেন। এর মধ্যে ৪ জন পুরুষ ও ২ জন নারী। যেসব জায়গায় ট্রাফিক রয়েছে এবং জনসমাগম বেশি হয়, সেসব জায়গায়ই তারা ফোকাস করতেন।
তিনি বলেন, ‘এটি অদ্ভুত, কারণ আমরা যদি মানুষকে দিকনির্দেশনা দিতে চাই, তবে কেন ব্যস্ত জায়গা বাছাই করতে হবে? এর সম্ভাব্য অর্থ এই যে, আমরা যাতে আরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করতে পারি। এ যেন আমরা শিকারে বের হচ্ছি।’
মাহসার মৃত্যুতে আন্দোলন করছে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ইরানিরা
সেই অফিসার বলেন, যদি পোশাকবিধি লঙ্ঘনকারী পর্যাপ্ত নারী চিহ্নিত করতে না পারতেন, তবে কমান্ডার তাকে তিরস্কার করতেন যে তিনি সঠিকভাবে কাজ করছেন না।
কমান্ডাররা আশা করেন যে আমরা তাদের ভ্যানের ভেতরে জোর করে নিয়ে যাব। এটা করতে গিয়ে আমি কতবার কেঁদেছি জানেন?
যাদের তিনি আটক করেছেন, তাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের বলতে চাই, আমি তাদের একজন নই। আমাদের বেশির ভাগই সাধারণ সৈনিক আমাদের বাধ্যতামূলক কাজ করতে হয়।’
ইরানে হিজাববিরোধী আন্দোলন কি নতুন কিছু
১৯৭৯ সালের পর ইসলামি বিপ্লবের পরপরই নারীদের পোশাকের বিধি নিষেধ দেয়া শুরু হয়, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল নারীদের শালীন পোশাক নিশ্চিত করা।
এটি অদ্ভুত, কারণ আমরা যদি মানুষকে দিকনির্দেশনা দিতে চাই, তবে কেন ব্যস্ত জায়গা বাছাই করতে হবে? এর সম্ভাব্য অর্থ এই যে, আমরা যাতে আরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করতে পারি। এ যেন আমরা শিকারে বের হচ্ছি।
আর ইরানের নারীদের হিজাববিরোধী আন্দোলন নতুন কিছু নয়। দেশটিতে বাধ্যতামূলক চুল ঢাকার নিয়ম চালু করার পর থেকেই বিভিন্ন সময় ইরানি নারীরা হিজাববিরোধী আন্দোলন করেছে।
আশির দশকে পোশাক বিধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে স্কার্ফ ছুড়ে ফেলছেন ইরানি নারীরা
ইসলামি বিপ্লবের বছর ১৯৭৯ সালের মার্চেই নারীরা বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। কয়েক দিন ধরে সে আন্দোলন চলতে থাকে। এ সময় তেহরানের রাস্তায় হাজারও ইরানি নারী চুল খোলা রেখে সমবেত হয়েছিল।
সত্তরের দশকে সমুদ্রসৈকতে ইরানি নারী ও পুরুষ
বিপ্লবের আগে ইরানের অবস্থা
ইসলামি বিপ্লবের আগে পশ্চিমাপন্থি শাসক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে উৎখাত করার আগে তেহরানের রাস্তায় মিনিস্কার্ট ও খোলা চুল কোনো অস্বাভাবিক দৃশ্য ছিল না।
পাহলভির স্ত্রী ফারাহও পশ্চিমা পোশাকে অভ্যস্ত ছিলেন।