৯৬ বছরের জীবনে ৭০ বছরই সিংহাসনে থেকেছেন দ্বিতীয় রানি এলিজাবেথ। বহু কিছুর সাক্ষী তিনি। মালিক হয়েছেন অনেক অর্থকড়িরও। তবে উত্তরাধিকারী রাজা চার্লসের জন্য কী পরিমাণ সম্পদ রেখে গেছেন তিনি, এ প্রশ্ন এখন অনেকের মনেই।
স্কটল্যান্ডে নিজের দুর্গ বালমোরালে বৃহস্পতিবার ৯৬ বছর বয়সে মারা যান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ৭০ বছরের শাসনামলে প্রায় ৪ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকার (৫০ কোটি ডলার) ব্যক্তিগত সম্পদ রেখে গেছেন রানি। উত্তরাধিকার সূত্রে এ সম্পদের মালিক এখন রাজা তৃতীয় চার্লস।
শুনতে সহজ মনে হলেও হিসাবটা বেশ জটিল। রানির ব্যক্তগত সম্পদের বাইরেও তার মালিকানাধীন হিসেবে বিবেচিত অনেক কিছু রয়েছে। তবে সেই সম্পদ আসলে তথাকথিত রয়্যাল ফার্মের অধীনে। প্রায় ২ লাখ ৬৬ হাজার ৩২২ কোটি টাকার (২৮ বিলিয়ন ডলার) এসব বাড়তি সম্পদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত।
এগুলোকে রাজা পঞ্চম জর্জ এবং প্রিন্স ফিলিপের মতো রাজপরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে ‘পারিবারিক ব্যবসা’ বলে বর্ণনা করেছেন।
রানি কীভাবে বেতন পেতেন?
সার্বভৌম অনুদান নামে পরিচিত করদাতা তহবিলের মাধ্যমে আয়ের একটি বড় অংশ আসত রানির। ব্রিটিশ রাজপরিবারকে এর মাধ্যমে বার্ষিক অর্থ দেয়া হয়ে থাকে। রাজা তৃতীয় জর্জের করা একটি চুক্তির মাধ্যমে এই তহবিল গঠিত হয়েছিল।
বাকিংহাম প্যালেস সূত্রে জানা যায়, এই অনুদানের পরিমাণ ২০২১ এবং ২০২২ সালে ৯৪৮ কোটি টাকা (৮৬ মিলিয়ন পাউন্ড) নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই তহবিল অফিশিয়াল ভ্রমণ, সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ এবং রানির পরিবারের পরিচালন খরচের জন্য বরাদ্দ করা হয়।
রয়্যাল ফার্ম: ২৮ বিলিয়ন ডলারের এক বিশাল সাম্রাজ্য
এই ফার্ম রাজতন্ত্রের পিএলসি নামে পরিচিত। এর কর্তৃপক্ষ হাউস অফ উইন্ডসরের জ্যেষ্ঠ সদস্য এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত, যার প্রধান ছিলেন রানি। টেলিভিশনভিত্তিক ইভেন্ট এবং পর্যটনশিল্পের মাধ্যমে এটি প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন ডলার যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে যুক্ত করে।
রানিসহ রাজপরিবারের আট সদস্য এই ফার্মের সদস্য ছিলেন। বাকিরা হলেন প্রিন্স চার্লস (বর্তমান রাজা) এবং তার স্ত্রী ক্যামিলা, প্রিন্স উইলিয়াম এবং তার স্ত্রী কেট, রানির মেয়ে প্রিন্সেস অ্যান, রানির ছোট ছেলে প্রিন্স এডওয়ার্ড এবং তার স্ত্রী সোফি।
যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ফোর্বস বলছে, ২০২১ সাল পর্যন্ত এই রাজপরিবারের আনুমানিক ২৮ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ রয়েছে, যেগুলো বিক্রি করা যাবে না।
ফোর্বসের হিসাবে, ১৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ক্রাউন এস্টেট, ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের বাকিংহাম প্যালেস, ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের কর্নওয়ালের ডাচি, ৭৪৮ মিলিয়ন ডলারের ল্যাঙ্কাস্টারের ডাচি, ৬৩০ মিলিয়ন ডলারের কেনসিংটন প্যালেস এবং ৫৯২ ডলারের স্কটল্যান্ডের ক্রাউন এস্টেট রয়েছে ব্রিটিশ রাজপরিবারের অধীনে।
যদিও পরিবারটি এই ব্যবসা থেকে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয় না, তবে এটি ব্রিটিশ অর্থনীতিকে চাঙা রাখে।
ক্রাউন এস্টেট
ক্রাউন এস্টেট হলো ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের অধীনে থাকা জমি। তবে এটি রানির নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এটি একটি আধা-স্বাধীন পাবলিক বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
গত জুনে ক্রাউন এস্টেট ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৩১২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারের নিট রাজস্ব মুনাফা ঘোষণা করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৪৩ মিলিয়ন ডলার বেশি।
সার্বভৌম অনুদানের জন্য তহবিল রাজস্বের লাভের শতাংশ থেকে আসে, যা রয়্যাল হাউসহোল্ডের মতে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল।
২০১৭-১৮ সালে বাকিংহাম প্যালেসের পুনর্নির্মাণে সহায়তার জন্য তা ২৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল; ২০২৮ সালের মধ্যে অনুদান ১৫ শতাংশ কমিয়ে আনার কথা।
অনুদানটি কর্মীদের বেতন, নিরাপত্তা, ভ্রমণ, গৃহস্থালি এবং রক্ষণাবেক্ষণের মতো অফিশিয়াল খরচের জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে রানি এবং তার বর্ধিত পরিবারের ব্যক্তিগত খরচ প্রিভি পার্স নামে একটি আলাদা ভাতার মাধ্যমে দেয়া হয়।
প্রিভি পার্স
কুইন্স প্রিভি পার্স মূলত সম্পত্তি এবং সম্পদের একটি পোর্টফোলিও; যা ল্যাঙ্কাস্টারের ডাচি থেকে রানিকে ব্যক্তিগত আয় প্রদান করছিল।
মোট সম্পদ সরাসরি রানিকে দেয়া হতো না। তবে বাড়তি ২৪ মিলিয়ন ডলারের থেকে মূলত সার্বভৌম অনুদানের অন্তর্ভুক্ত নয়, এমন খরচগুলোতে ব্যয় করা হতো।
মহামহিমের ব্যক্তিগত সম্পদ
বিজনেস ইনসাইডারের মতে, রানির ব্যক্তিগত সম্পদের অর্থমূল্য ৫০ কোটি ডলারের বেশি। এই অর্থ মূলত রানির শিল্পকর্ম সংগ্রহ, অলংকার এবং আবাসন খাতে বিনিয়োগ থেকে এসেছে। তিনি মারা যাওয়ার পর এখন এই সম্পদের মালিক রাজা তৃতীয় চার্লস।
২০০২ সালে রানির মা মারা যাওয়ার পর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রায় ৭ কোটি ডলারের সম্পদ পেয়েছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এসবের মধ্যে আছে পেইন্টিং, স্ট্যাম্প, অলংকার, ঘোড়া এবং মূল্যবান ফেবারজ ডিম। সংগ্রহের পেইন্টিংগুলোর মধ্যে আছে মোনেট, ন্যাশ এবং কার্ল ফাবার্গের শিল্পকর্ম।
একটি বিশেষ আইনি ধারা আছে, যা রানিকে তার মায়ের রেখে যাওয়া সম্পত্তির উত্তরাধিকার কর প্রদান থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল। এই ধারা নতুন রাজা চার্লসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
তবে রাজা তৃতীয় চার্লস এখনও ২৮ বিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্যের সরাসরি উত্তরাধিকার হবেন না। তিনি কেবল রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বিশেষভাবে মনোনীত ব্যক্তিগত সম্পদ পাবেন।