বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নতুন বিল নিয়ে উত্তাল ভারতের সংসদ, বিরোধীদের তীব্র প্রতিক্রিয়া

  • নিউজবাংলা ডেস্ক   
  • ২১ আগস্ট, ২০২৫ ১০:৩৩

ভারতের সংসদে উপস্থাপিত একটি বিতর্কিত বিলকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উত্তাল বিতর্ক। বিলটির মাধ্যমে এমন একটি বিধান চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে গুরুতর অপরাধমূলক মামলায় অভিযুক্ত ও অন্তত ৩০ দিনের জন্য গ্রেপ্তার হওয়া কোনো উচ্চপদস্থ জনপ্রতিনিধি- প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী বা মন্ত্রী—অটোমেটিকভাবে তাদের পদ হারাবেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই অপসারণের জন্য অপরাধের বিচার শেষ হওয়া বা আদালতের দোষী সাব্যস্ত করার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র ‘গুরুতর অভিযোগে’ গ্রেপ্তার এবং ৩০ দিন জেলে থাকাই যথেষ্ট।

বিরোধীরা একে আখ্যা দিচ্ছেন ‘একটি বিপজ্জনক ও অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ’ বলে। বিরোধীদের তুমুল আপত্তির মধ্যেই ভারতের লোকসভায় গুরুতর অপরাধের অভিযোগ গ্রেপ্তার হওয়া প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীদের অপসারণ বিল পেশ করেছেন দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত এই বিল পেশ হতেই লোকসভায় ব্যপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

গতকাল বুধবার লোকসভায় মোট তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পেশ করেন অমিত শাহ। এর মধ্যে রয়েছে- কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল প্রশাসন (সংশোধনী) বিল ২০২৫, সংবিধান (১৩০ তম সংশোধনী) বিল ২০২৫ এবং জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্বিন্যাস (সংশোধনী) বিল ২০২৫। ওই বিলগুলো মূলত সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে আনা। তবে বিরোধী দলগুলো প্রস্তাবিত সংবিধান (১১৩ তম সংশোধনী) বিল নিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে।

প্রস্তাবিত ওই বিলে বলা হয়েছে, দেশের প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং মন্ত্রীপদে আসীন অবস্থায় কেউ যদি গুরুতর অপরাধে ৩০ দিনের বেশি জেলে থাকেন তাহলে তাকে পদ থেকে অপসারণ করা হবে। রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপালদের হাতে এই অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হবে।

এদিন অমিত শাহের বিল পেশের সঙ্গে সঙ্গে তুমুল হট্টগোল শুরু করে কংগ্রেসসহ গোটা বিরোধী শিবির। ওয়েলে নেমে প্রতিবাদে শুরু করেন তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদরা। এমনকি বিলের কপি ছিঁড়ে অমিত শাহের দিকে ছুড়ে মারেন তারা। এছাড়া তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তেজিত হয়ে অমিত শাহর কাছে চলে যান। বাধ্য হয়ে অধিবেশন মুলতুবির ঘোষণা দেন স্পিকার ওম বিড়লা।

অন্যদিকে, ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করা হয় এবং অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের পর অঞ্চলটি কেন্দ্রশাসিত রাজ্যে পরিণত হয়। সেই সময় থেকে স্থানীয় মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলো বারবার দাবি জানিয়েছেন রাজ্যের স্বতন্ত্র মর্যাদা এবং পূর্ণাঙ্গ রাজ্যত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।

অনেকের মতে, এবার হয়তো সেই দাবি বাস্তবে পরিণত হতে চলেছে জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্বিন্যাস (সংশোধনী) বিল ২০২৫-র মাধ্যমে।

এ প্রসঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেছেন, সংসদের চলতি অধিবেশনে কাশ্মীরবাসীর জন্য কিছু ইতোবাচক ঘটতে পারে। তার বক্তব্য, ‘আমরা অনেক দিন ধরে অপেক্ষা করছি। যদি সরকার সত্যিই রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে এটি গণতন্ত্রের জন্য এবং কাশ্মীরের জনগণের জন্য এক বড় ইতোবাচক পদক্ষেপ হবে।’

বিরোধী দলগুলি মনে করছে, এই বিল কার্যকর হলে কেন্দ্র সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক মামলার ভিত্তিতে তাদের জেলে পাঠিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদচ্যুত করতে পারবে। এর ফলে জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেতৃত্বকে বিচার ছাড়াই সরিয়ে দেওয়া যাবে, যা ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোর সম্পূর্ণ বিরোধী।

কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রা এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি একে সম্পূর্ণরূপে স্বৈরাচারী এবং অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ বলে মনে করি। এটিকে দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দেওয়া আসলে জনগণের চোখে ধুলো দেওয়া। কালকেই যদি কোনো বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো মিথ্যা মামলা করে তাকে ৩০ দিনের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে কি তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদ হারাবেন? এটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর বিরুদ্ধে।’

অন্যদিকে বিশিষ্ট আইনজীবী ও কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভি বলেন, ‘বিজেপি বুঝতে পেরেছে তারা ভোটে হারতে বসেছে, তাই এখন বিরোধী সরকারগুলিকে ভেঙে ফেলার জন্য আইনি হাতিয়ার বানাতে চাইছে। তারা কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে দিয়ে বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার করাবে, আর এই বিল কার্যকর হলে সেই নেতাদের বিচার না-হতেই পদচ্যুত করে দেবে।’

বিরোধীরা ওই প্রস্তাবিত বিলকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের উদাহরণ টানেন। তিনি ২০২৪ সালের মার্চ মাসে কথিত মদের নীতি দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার হন এবং সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার আগ পর্যন্ত পাঁচ মাসেরও বেশি সময় জেলবন্দি ছিলেন। যদিও তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো দোষ প্রমাণ হয়নি, বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি, তবুও বিজেপি ও তার মিত্ররা তার পদত্যাগ দাবি করে। কেজরিওয়াল সেইসময় বলেছিলেন, ‘আমি এখনো দোষী সাব্যস্ত হইনি, আমার বিচার পর্যন্ত হয়নি, তাহলে কেন আমি পদত্যাগ করব?’

যদি এই প্রস্তাবিত আইন তখন কার্যকর থাকত, তবে ৩০ দিন পূর্ণ হতেই তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে অপসারিত করা হতো।

একই রকম ঘটনা ঘটেছে তামিলনাড়ুতেও, যেখানে ডিএমকে নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী ভি সেন্টিল বালাজিকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্টালিন তাকে মন্ত্রী হিসেবে বহাল রাখলেও তার দপ্তর ছিনিয়ে নেওয়া হয়। রাজ্যপাল আর এন রবি এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করলে তা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। পরে চাপের মুখে বালাজি পদত্যাগ করেন।

বিভিন্ন বিরোধী দল একযোগে ওই বিলের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে। আরএসপির সাংসদ এন কে প্রেমচন্দ্রন বলেন, ‘এই বিলের উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট – বিজেপি বিরোধী দলগুলোর সরকার ভেঙে দিতে চাইছে। কেন্দ্র সরকারের অধীনে থাকা সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে তারা বিরোধীদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক মামলা করছে। এখন সেই অবৈধ কাজকে আইনি বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’

এআইএমআইএম প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়েইসি আরও কঠোর ভাষায় বলেন, ‘বিজেপি আমাদের দেশকে পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে। তারা পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ মডেল অনুসরণ করছে, যেখানে বিরোধী নেতারা হয় জেলে থাকে না হয় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু ভারতের গণতন্ত্র এত সহজে ভাঙবে না। আমরা এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করব।’

আরজেডি নেতা সুধাকর সিং বলেন, ‘এটা ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য এক বিপজ্জনক মোড়। আজ বিরোধী নেতাদের জেলে পাঠিয়ে তাদের ক্ষমতা থেকে সরানোর পরিকল্পনা চলছে, কাল দেশের বাকস্বাধীনতা ও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে।’

অন্যদিকে বিজেপির দাবি, এই বিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি কার্যকর পদক্ষেপ। তারা বলছে, দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্তরা যাতে ক্ষমতায় থেকে প্রমাণ লোপাট বা প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সেই লক্ষ্যে এই আইন প্রয়োজনীয়।

বিজেপির কর্নাটকের বিধায়ক অরবিন্দ বেল্লাড বলেন, ‘বিগত সময়ে অনেক মুখ্যমন্ত্রী জেলে থেকেও সরকার চালানোর চেষ্টা করেছেন। এমন পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে শক্তিশালী আইন দরকার। এই বিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতির প্রতিফলন।’

বর্তমানে ভারতের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী, কোনো সাংসদ বা বিধায়ক যদি এমন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন যার শাস্তি কমপক্ষে দুই বছরের কারাদণ্ড, তবে তিনি তার পদ হারান। কিন্তু বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার পদে থাকা নিয়ে কোনো বাধা নেই। প্রস্তাবিত নতুন আইনে এই ব্যতিক্রম তুলে দিয়ে শুধুমাত্র গ্রেপ্তার এবং ৩০ দিন জেলেই পদচ্যুতি ঘটানোর কথা বলা হয়েছে।

এই বিল নিয়ে সংসদে প্রচণ্ড বিতর্ক চলছে এবং জনমতও দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের যুক্তি; অন্যদিকে, বিচার ছাড়াই পদচ্যুতির আশঙ্কায় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।

এ বিভাগের আরো খবর