কানাডিয়ান গুপ্তচরের মাধ্যমে শামীমা বেগমকে সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের জন্য পাচার করা হয়েছিল। নিরাপত্তা পরিষেবাগুলো এতদিন ওই গুপ্তচরের ভূমিকা গোপন রেখেছিল। সাংবাদিক রিচার্ড কেরবাজের ‘দ্য সিক্রেট হিস্ট্রি অফ ফাইভ আইস’ বইয়ে এ দাবি করা হয়।
ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের নেটওয়ার্ক হলো ফাইভ আইস।
বইয়ে বলা হয়, অটোয়ার বিরুদ্ধে শামীমার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য গোপন করার অভিযোগ উঠলে ব্রিটিশ পুলিশ একটি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান পরিচালনা করে।
যদিও ব্রিটেন ছাড়ার চার দিন পর্যন্ত শামীমার বিষয়ে কিছু জানতেন না বলে দাবি করেন কানাডিয়ান গোয়েন্দারা। এ সময়ে শামীমা সিরিয়ায় ঢুকে পড়েছিলেন।
২০১৫ সালে বেথনাল গ্রিন অ্যাকাডেমির দুই সহপাঠীকে নিয়ে পূর্ব লন্ডন থেকে যখন সিরিয়া যান, তখন শামীমা ছিলেন ১৫ বছরের এক স্কুলছাত্রী।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত বইয়ে কেরবাজ বলেন, ১৬ বছরের বন্ধু কাদিজা সুলতানা এবং ১৫ বছরের আমিরা আবেসের সঙ্গে ব্রিটেন ছাড়েন শামীমা। তারা তুরস্কের ইস্তানবুল বাসস্টেশনে মোহাম্মদ আল রাশেদ নামে একজনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এই রাশেদই তাদের সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটিতে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
রাশেদ একজন ডাবল এজেন্ট ধারণা করা হচ্ছে। তিনি কানাডার সঙ্গে শামীমার পাসপোর্টের বিবরণ শেয়ার করেছিলেন। আইএসের হয়ে লড়াই করতে ব্রিটেন থেকে আরও কয়েক ডজন মানুষ পাচার করেছিলেন রাশেদ।
শামীমার আইনজীবী তাসনিম আকুঞ্জি বলে আসছিলেন যে কিশোরীদের পাচার করা হয়েছে। এ কাজে পশ্চিমা একটি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত থাকতে পারে। স্কুলছাত্রীদের জন্য বাস টিকিটের ব্যবস্থাসহ সিরিয়া যেতে সার্বিক সহায়তা করেছে গোয়েন্দারা।’
ব্রিটিশ পুলিশও একসময় এ দাবি মেনে নেয়। তারা জানায়, কিশোরীদের পাচারে কানাডিয়ান এক ডাবল এজেন্ট কাজ করেছেন বলে তথ্য রয়েছে তাদের কাছে।
বইয়ে কেরবাজ লেখেন, “কানাডার গোয়েন্দা পরিষেবা বিস্ফোরক অভিযোগের বিষয়ে নীরব ছিল। তারা এমন একটি অবস্থান নিয়েছিল, যা সব গোয়েন্দা সংস্থাকে রক্ষা করে।”
কেরবাজ বলেন, ‘সাত বছর ধরে কানাডিয়ানরা এটি গোপন করে রেখেছিল। বইটি লেখার আগে একাধিক কানাডিয়ান গোয়েন্দা কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তারাই আমাকে এ ঘটনার টাইমলাইনগুলো নিশ্চিত করেছেন।
‘আমি মনে করি এমন গোপনীয়তা অন্য সব অপরাধের চেয়েও খারাপ। কারণ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অপরাধী বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়োগ দেবে, এমনটা আপনি আশা করেন না।’
কেরবাজ বলেন, ‘পাচারে রাশেদের ভূমিকা জানতে পেরেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাকে আটকে কিছুই করেনি।
‘আমি মনে করি তারা আসলে ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইছিল। কারণ আইএসের কাছে তখনও ব্রিটিশসহ অনেক পশ্চিমা নাগরিক জিম্মি ছিল।
‘এ ছাড়া ব্রিটিশ সরকার আরও কিছু বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। কারণ এ সময়ে তারা আইএসের ভেতরকার খবর জানার চেষ্টা করছিল। যদি আইএস জানতে পারে যে তাদের এক সদস্য কানাডার গোয়েন্দাদের হয়ে কাজ করছেন, তবে তারা তখন আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠত এবং আটকদের শিরোশ্ছেদ করা শুরু করত।’
সুপ্রিম কোর্ট গত বছর শামীমাকে যুক্তরাজ্যে ফিরে আসতে বাধা দেয়ার ২০১৯ সালের সিদ্ধান্তকে বহাল রাখে। শামীমা উত্তর সিরিয়ার একটি বন্দি শিবিরে বাস করছেন। সেখানে জন্ম নেয়া তার তিন সন্তানের সবাই অল্প বয়সে মারা যায়।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এমন কোনো পরামর্শ ছিল না যেখানে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সিরিয়ায় তার পাচারের পরিস্থিতি জানত।
আগামী নভেম্বরে বিশেষ অভিবাসন আপিল কমিশনে একটি নতুন মামলা করার কথা রয়েছে শামীমার।
আকুঞ্জি বলেন, ‘মামলার একটি মূল যুক্তি হবে তৎকালীন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ পাচারের বিষয়টি বিবেচনায় নেননি।
‘পাচার হওয়া ব্যক্তিকে আমরা কীভাবে দেখি এবং তাদের কাজের জন্য আমরা তাদের কীভাবে দোষারোপ করি, সে বিষয়ে যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পশ্চিমা গোয়েন্দাদের সম্পদ ছিলেন রাশেদ। তার এমন একজন হওয়ার কথা ছিল, যিনি ব্রিটিশ শিশুদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাচার করার পরিবর্তে জনগণকে রক্ষা করবেন।’
শামীমাদের পাচারের দুই বছর আগে ২০১৩ সালে জর্ডানে কানাডিয়ান দূতাবাসে আশ্রয়ের আবেদন করতে গিয়েছিলেন রাশেদ। এটাও বলা হয়, দূতাবাসে তিনি দাবি করেছিলেন যে আইএসের কার্যকলাপ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে পারলে কানাডা সরকার তাকে নাগরিকত্ব দেবে।
বলা হচ্ছে, বাসের টিকিট কেনার জন্য পরিচয়পত্র লাগবে বলে কিশোরীদের বলেছিলেন রাশেদ। পরে সবার পাসপোর্টের ছবি তোলেন তিনি। এরপর সেগুলো জর্ডানের দূতাবাসে কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসে নিজের হ্যান্ডলারের কাছে পাঠিয়ে দেন রাশেদ।
শামীমাসহ অন্য মেয়েদের পাচারের কদিন পর তুরস্কের সানলিউরফা শহর থেকে গ্রেপ্তার হন রাশেদ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে রাশেদ জানান, সিরিয়া যেতে যাদের সাহায্য করেছিলেন, তাদের সবার তথ্য তার কাছে আছে। জর্ডানে কানাডিয়ান দূতাবাসের কাছে এসব তথ্য শেয়ার করেছেন তিনি।
রাশেদ সম্পর্কে শামীমা বলেন, ‘তুরস্ক থেকে সিরিয়ার পুরো ট্রিপটি তিনিই সাজিয়েছিলেন। আমার মনে হয় না পাচারকারীদের সাহায্য ছাড়া কেউ তখন সিরিয়ায় যেতে পারত।
‘তিনি অনেক মানুষকে সিরিয়া যেতে সাহায্য করেছিলেন। উনি আমাদের যা করতে বলেছিলেন আমরা তা-ই করেছিলাম। কারণ তিনি সবকিছু জানতেন, আমরা কিছুই জানতাম না।’
এ ঘটনায় মন্তব্য করতে রাজি হননি কানাডা সরকারের এক মুখপাত্র। যুক্তরাজ্য সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের নীতি হলো, অপারেশনাল ইন্টেলিজেন্স বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে মন্তব্য করি না।’