বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন মিখাইল গর্বাচেভ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় তিনি ছিলেন রাষ্ট্রটির প্রেসিডেন্ট, যেটি টিকে ছিল প্রায় ৭০ বছর। এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সে রাষ্ট্র।
১৯৮৫ সালে সংস্কার কর্মসূচি শুরুর সময় গর্বাচেভের মূল লক্ষ্য ছিল নিজ দেশের স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো।
তার উদ্যোগ বেশ কিছু ঘটনার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নে নয়, রাষ্ট্রটির ছায়ায় থাকা অন্য রাষ্ট্রগুলোতেও অবসান ঘটায় কমিউনিস্ট শাসনের।
রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় স্ট্যাভরোপোল এলাকায় ১৯৩১ সালের ২ মার্চ জন্ম হয় মিখাইল সের্গেয়েভিচ গর্বাচেভের। তার মা ও বাবা কাজ করতেন যৌথ খামারে। খামারে কম্বাইন্ড হারভেস্টার চালাতেন কিশোর গর্বাচেভ।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন গর্বাচেভ। ১৯৫৫ সালে সেখান থেকে স্নাতক পাস করার সময় তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে স্ত্রী রাইসাকে নিয়ে স্ট্যাভরোপোলে ফিরেন গর্বাচেভ। এরপর দ্রুতই আঞ্চলিক রাজনীতিতে একের পর এক শীর্ষ পদে যেতে থাকেন তিনি।
কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়া নতুন প্রজন্মের নেতাদের একজন ছিলেন গর্বাচেভ যিনি সোভিয়েতে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা বর্ষীয়ান নেতাদের প্রতি ক্রমশ বিরক্ত হচ্ছিলেন। ১৯৬১ সালে যুব কমিউনিস্ট লিগের আঞ্চলিক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। একই সময়ে দলীয় কংগ্রেসে প্রতিনিধি মনোনীত হন।
কৃষি প্রশাসক হিসেবে উদ্ভাবনী ক্ষমতা বিকাশের সুযোগ পান গর্বাচেভ। অন্যদিকে দলীয় অবস্থানের কারণে আঞ্চলিক রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি হয় তার।
নতুন পথচলা
কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষি দপ্তরের সদস্য হিসেবে ১৯৭৮ সালে মস্কোতে যান গর্বাচেভ। এর দুই বছর পর দলের পলিটব্যুরোর পূর্ণাঙ্গ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
ইউরি আন্দ্রোপভ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক থাকার সময় বেশ কয়েকবার বিদেশ সফর করেন গর্বাচেভ। ১৯৮৪ সালে লন্ডন সফরের সময় ‘লৌহমানবী’ খ্যাত যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের নজরে পড়েন তিনি।
সে সময় বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে থ্যাচার বলেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের বিষয়ে তিনি আশাবাদী।
‘আমি গর্বাচেভকে পছন্দ করি। আমরা একত্রে কাজ করতে পারি’, বলেছিলেন থ্যাচার।
১৯৮৪ সালে আন্দ্রোপভের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরি হওয়ার কথা ছিল গর্বাচেভের, তবে শেষ পর্যন্ত অসুস্থ কনস্টান্টিন চেরনেঙ্কোকে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয়।
এক বছরের মধ্যে চেরনেঙ্কোরও মৃত্যু হয়। তার উত্তরসূরি হন পলিটব্যুরোর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য গর্বাচেভ।
১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর জন্ম নেয়া প্রথম ব্যক্তি হিসেবে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন গর্বাচেভ। লিওনেদ ব্রেজনেভের নেতৃত্বাধীন সময়কার স্থবিরতার পর তাকে দিয়ে শুরু হয় কমিউনিস্ট পার্টির নতুন পথচলা।
গর্বাচেভের স্টাইলিশ পোশাক, সোজাসাপ্টা আচরণ ছিল তার পূর্বসূরিদের বিপরীত। তার স্ত্রী রাইসাকে আমেরিকার ফার্স্ট লেডির মতোই মনে হতো।
মুক্তবাজার অর্থনীতি
গর্বাচেভের প্রথম কাজ ছিল পতনের দ্বারপ্রান্তে থাকা সোভিয়েত অর্থনীতিকে টেনে তোলা। অর্থনীতিতে সংস্কারের পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টিকেও খোলনলচে বদলানোর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি।
তার সমাধান নিহিত ছিল রুশ দুটি শব্দে। তিনি বলতেন দেশের ‘পেরেস্ত্রোইকা’ বা পুনর্গঠন দরকার। এটা করতে ‘গ্লাসনস্ত’ (উন্মুক্ততা) ব্যবহার করেছেন তিনি।
লেনিনগ্রাদে (১৯৯১ সালে নাম বদলে হয় সেন্ট পিটার্সবার্গ) কমিউনিস্ট পার্টির এক অনুষ্ঠানে গর্বাচেভ জ্যেষ্ঠ নেতাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘অন্য অর্থনীতির চেয়ে আপনারা পিছিয়ে আছেন।’
অর্থনীতিতে একচ্ছত্র রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করলেও সোভিয়েত ইউনিয়নে পুরোপুরি মুক্তবাজার অর্থনীতি কায়েমের ইচ্ছা ছিল না গর্বাচেভের। ১৯৮৫ সালে দলের কংগ্রেসে প্রতিনিধিদের উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যে তিনি সেটি পরিষ্কার করেছিলেন।
সে বছর তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাদের কেউ কেউ বাজারকে অর্থনীতির প্রাণরক্ষাকারী হিসেবে দেখেন, তবে কমরেডগণ, আপনাদের জীবনরক্ষাকারীকে নিয়ে চিন্তিত না হয়ে জাহাজ নিয়ে ভাবা উচিত। সে জাহাজ হলো সমাজতন্ত্র।’
স্থবির হয়ে পড়া ব্যবস্থা মোকাবিলায় গর্বাচেভের আরেক অস্ত্র ছিল গণতন্ত্র। তার সময়ে প্রথমবারের মতো সোভিয়েতের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ কংগ্রেস অফ পিপল’স ডেপুটিজের নির্বাচন হয় অবাধ।
‘অগ্নিপরীক্ষা’
গর্বাচেভের পূর্বসূরি সোভিয়েত শাসকদের জবরদস্তিমূলক আচরণে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরে কাজাখস্তানে দাঙ্গায় রাষ্ট্রে বেশ কিছুদিন অস্থিরতা ছিল।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসান চেয়েছিলেন গর্বাচেভ, যা তিনি করতে পেরেছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন পরমাণু বাহিনী চুক্তির মাধ্যমে পুরো এক সেট অস্ত্র ধ্বংস করে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সঙ্গে সফল সমঝোতার মাধ্যমে।
গর্বাচেভ এককভাবে সোভিয়েত আমলের প্রথাগত বাহিনীর সংখ্যা খর্ব করেন, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে আফগানিস্তানে শোচনীয় ও রক্তাক্ত দখলদারিত্বের অবসান ঘটায়।
সোভিয়েত এ নেতা সবচেয়ে বড় পরীক্ষায় পড়েন অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে। ওই রাষ্ট্রগুলোর জনগণ স্বাধীন হওয়ার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন।
শুরুতে জনগণের প্রতিবাদ বলপ্রয়োগে থামিয়ে দেন গর্বাচেভ। এরপরও সোভিয়েত ভাঙা শুরু হয় উত্তরাঞ্চলীয় বাল্টিক প্রজাতন্ত্রগুলো বিচ্ছিন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে।
লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও এস্তোনিয়া মস্কোর আওতামুক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে একে একে সোভিয়েত ছেড়ে যায় অনেক রাষ্ট্র।
বিবিসি অবলম্বনে