অর্থনৈতিক মন্দায় বিপর্যস্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বেও জ্বালানি, খাদ্যপণ্যের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমেরিকার সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে বলেছে, দেশটির নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ জীবনধারণের জন্য এখন একের বেশি চাকরি করছেন। প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করেছেন রুবাইদ ইফতেখার।
নর্থ ক্যারোলাইনার অ্যামাজন গুদামে কাজ করেন আলবার্ট এলিয়ট। নিজের বাড়ি ফেটেভিল থেকে কাজে যেতে তাকে পাড়ি দিতে হয় ৬০ মাইল (৯৬.৫ কিমি)। এ দূরত্বটুকু পাড়ি দেয়ার জন্য তার কিয়া সোল গাড়ির জন্য ১৫ ডলারের তেল নিতে হতো। ধীরে ধীরে এই দাম ২০ এবং এখন ২৫ ডলারে পৌঁছেছে। আলবার্ট তার কাজের জন্য ঘণ্টাপ্রতি পান ১৫.৭৫ ডলার। এখন তার হাতে গাড়ির তেলের ট্যাংক ভরার মতো যথেষ্ট অর্থ সঞ্চিত থাকে না।
জুনে তেলের দাম এতটাই বেড়েছে যে এলিয়টকে একটি কমিউনিটি কলেজে কেয়ারটেকারের কাজ নিতে হয়। সপ্তাহে সেখানে তিনি ঘণ্টায় ১০ ডলার হিসাবে বাড়তি দুই দিন কাজ করেন।
ওয়াশিংটন পোস্টকে এলিয়ট বলেন, ‘তেলের দাম আকাশছোঁয়া। বেতন পাওয়ার দিন বাদে হাতে যা অর্থ থাকে সবই খরচ হয়ে যায়। অনেক সময় পরিবার-পরিজনদের কাছে ধার করতে হয়। অ্যামাজনে কাজ করে যে টাকা পাই সেটা তেল কেনার জন্য যথেষ্ট নয়, এটা আমি বুঝে গেছি। আমার চিন্তা হচ্ছে যে রোজগার করতে সামনে হয়তো কাজেই যেতে পারব না। এখন যে অবস্থা তাতে এর-ওর কাছ থেকে ধার করে চলতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি সোমবার গাড়ির ট্যাংকে ২৫ ডলারের তেল ভরলাম। সেটা বেশিদিন চলেনি। আজ সকালে (বুধবার) আমাকে আমার গাড়ির ট্যাংকে আরও ১৫ ডলারের তেল ভরতে হয়েছে। যে কারণে আজকে কাজে আসতে পেরেছি। আগামীকাল বাড়ি ফিরতে আরও ২০ ডলারের তেল নিতে হবে। আমি এখন র্যালেতে অ্যামাজনে কাজ করছি। এখানে কাজ শেষ করে আমাকে পার্টটাইম পরিচ্ছন্নতার কাজে যেতে হবে।’
প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারের কারণে পারিশ্রমিক বেড়েছে আমেরিকান শ্রমিকদের। তারপরও সেটি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পেরে উঠছে না। জুনে দেশে ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল। ফলে এলিয়টের মতো শ্রমজীবীদের দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে দ্বিতীয় আরেকটি চাকরি খুঁজতে হচ্ছে।
সেইন্ট লুইস ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের মার্চ থেকে একাধিক কাজ করেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে। ২০২০ সালের এপ্রিলে এই হার ছিল ৪ শতাংশ, যা ২০২২ সালের জুনে বেড়ে ৪.৮ শতাংশ হয়েছে। যদিও এই হার মহামারির আগের তুলনায় কম।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকায় ৫.১ শতাংশ কর্মী দুই বা ততোধিক চাকরি করতেন। একাধিক চাকরির সুযোগ একটি ভালো চাকরির বাজারের লক্ষণ হওয়ার সঙ্গে আমেরিকানদের মানিব্যাগের ওপর আর্থিক চাপ বৃদ্ধির একটি চিহ্ন হিসেবেও দেখা দিচ্ছে।
ইনডিডস হায়ারিং ল্যাবের অর্থনৈতিক গবেষণার পরিচালক নিক বাঙ্কার বলেন, ‘অনেকেই বাড়তি টাকা উপার্জনের জন্য আরেকটি চাকরি খোঁজেন। শ্রমবাজার শক্তিশালী হলে সে সুযোগ পাওয়া যায়। তবে আমার মতে, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বাড়তি উপার্জন বা দ্বিতীয় বা তৃতীয় চাকরি খোঁজার প্রবণতা অনেকের মধ্যে বেড়েছে।’
দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে শ্রমিকরা ক্রমে দ্বিতীয় চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন এবং সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টার বেশি কাজ করছেন। মহামারির আগের অবস্থার চেয়ে এখন একাধিক চাকরি করা লোকের সংখ্যা কম হলেও সপ্তাহে ৩৫ ঘণ্টা কাজ করতে হয় এমন পূর্ণকালীন একাধিক চাকরি করা লোকের সংখ্যা ১৯৯৪ সালের পর থেকে বেড়েছে। ওই বছর থেকে বুরো অফ লেবার স্ট্যাটিসটিকস (বিএলএস) এ ডেটা সংগ্রহ করা শুরু করে। চলতি বছরের জুনে ৪ লাখ ২৬ হাজার আমেরিকান দুটি পূর্ণকালীন চাকরি করতেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৮ হাজার।
বামপন্থি থিংকট্যাংক ইকোনমিক পলিসি ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট হাইডি শিয়েরহোলস বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা চাকরিতে উন্নতির অনেক বেশি সুযোগ পাচ্ছেন। মূল্যস্ফীতির উচ্চহার ও চাকরির সহজলভ্যতার কারণে অনেকেই যে একাধিক চাকরি করছেন সেটা মোটেও চমকপ্রদ নয়।’
অবসর ও হসপিটালিটিতে নিম্ন মজুরির চাকুরেদের বেতন গত কয়েক দশকে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। তারা লভ্যাংশ পাওয়ার সুযোগ, উচ্চ বেতন নিয়ে আলোচনা, চাকরি ছেড়ে দেয়া ও ইউনিয়ন করার নতুন সুবিধাও পেয়েছেন। এ বছরের জুনে সরকারি ডেটা অনুযায়ী গত বছর ঘণ্টায় গড় আয় ৫.১ শতাংশ বেড়েছে।কিন্তু অধিকাংশ কর্মীর জন্য, এমনকি সর্বনিম্ন বেতনের খাতে যেখানে মজুরি দ্রুত বাড়ছে, মুদ্রাস্ফীতির কারণে বেতন বৃদ্ধি কোনো সুবিধা দিতে পারছে না। বিএলএসের ডেটা অনুযায়ী মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হলে সামগ্রিক মজুরি প্রকৃতভাবে ৩.৬ শতাংশ কমেছে।
বাঙ্কার বলেন, ‘এখনও অনেকে আছেন যারা মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি টাকা পাচ্ছেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা কয়েক মাস আগেও যেমন ছিল তার চেয়ে কমে এসেছে। আগের যারা বলতেন, তাদের বেতনের বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি, তারা এখন বলছেন মূল্যস্ফীতির কারণে তারা ওই বৃদ্ধি সুবিধা পাচ্ছেন না।’
বিএলএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতির কারণে জ্বালানি, খাদ্য ও বাড়িভাড়া আকাশছোঁয়া। এটি কম মজুরির শ্রমিকদের ক্ষতি করেছে, কারণ তারাই সাধারণত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিতে সবচেয়ে বেশি ভোগেন। তারা তাদের আয়ের একটি বড় অংশ সেসব ক্ষেত্রে খরচ করেন যেগুলো কমানো কঠিন।
কুইন্সে স্বতন্ত্র ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেন হার্মিস দিয়াজ। বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি ও আবাসিক নির্মাণ খাতে কাজের সুযোগ কম হওয়ার কারণে মে মাসে তিনি ক্লিনার হিসেবে আরেকটি চাকরি করা শুরু করেন। এখন তিনি বাড়িভাড়া ও মেয়ের কলেজের টিউশনের জন্য সপ্তাহে ৬০ থেকে ৯০ ঘণ্টা কাজ করার জন্য দুটি চাকরি করছেন।
দিয়াজ বলেন, ‘আগে যা কিনতাম সেগুলো এখন কিনতে পারি না। এমনকি সস্তা কাপড়, ফল, চালও না। ডিমের দামও অনেক বেড়েছে। আমার অন্য খরচও আছে। যে কারণে আমি এখন অনেক কম কিনছি, কিন্তু তাতেও আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ হচ্ছে।’
অ্যানিশা উইলিয়ামস, লস অ্যাঞ্জেলেসের একজন ৩৭ বছর বয়সী সিঙ্গেল মাদার, যিনি হোম কেয়ার প্রোভাইডার হিসেবে প্রতি ঘণ্টায় ১৬.২৫ ডলার আয় করেন। বাড়তি উপার্জনের জন্য তিনি গত বছর ফাস্ট ফুড চেইন জ্যাক ইন দ্য বক্সের ড্রাইভ-থ্রুতে ক্যাশিয়ার হিসেবে আরেকটি চাকরি শুরু করেন। গত মাসে তার বাড়িওয়ালা দুই বেডরুমের জন্য ভাড়া ১৩০ ডলার বাড়িয়ে মাসে ১৭৩০ ডলার করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমি হোমলেস হওয়ার একেবারে কাছাকাছি। কখনও কখনও আমার ফোন বিল বাকি থাকে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল বাকি থাকে। যখন ৯৯ শতাংশ জিনিসের মূল্য বাড়ছে তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে কোথাও কোনো গণ্ডগোল হচ্ছে।’
বেশি পারিশ্রমিক যারা পান বা হোয়াইট-কলার চাকুরেরা রিমোট বা ঘর থেকে কাজ খুঁজে বের করে জ্বালানি খরচ কমাচ্ছেন, এটি তাদের যাতায়াত এড়াতে বা সস্তা শহরে বসবাসকে সম্ভব করে তোলে। জুন মাসে কানেকটিকাটের কুইনিপিয়াক ইউনিভার্সিটির এক জরিপে দেখা গেছে, ৫২ শতাংশ আমেরিকান তেলের দাম বাড়ার কারণে গাড়ি চালানো উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছেন।অবশ্য বেশির ভাগ শ্রমিকের কাছে সে বিকল্প নেই। হসপিটালিটি ও সার্ভিস সেক্টরে যারা কাজ করেন তাদের কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত থাকতে হয়। এ কারণে তেলের জন্য তাদের প্রচুর খরচ করতে হয়। বিএলএসের এক জরিপ বলছে, ২০২১ সালে করোনা মহামারির কারণে যখন অনেক অফিস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তখনও আমেরিকায় বেসরকারি খাতের মাত্র ১৩ শতাংশ কর্মী সার্বক্ষণিক বাড়ি থেকে তাদের কাজ করেছেন। ৭৮ শতাংশ খুব কম বা কখনই বাড়ি থেকে কাজ করেননি।