পদ্মা সেতু বিশ্বের দ্বিতীয় খরস্রোতা নদীর দুই পাড়কে যুক্ত করেছে বটে, তবে স্রোতের চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নদীর নিচে শক্ত মাটির অনুপস্থিতি। বিশ্বের অনেক জায়গায় এ রকমই প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জের মুখে গড়ে উঠেছে কিছু সেতু। কোথাও খরস্রোতা নদী, কোথাও সুউচ্চ পাহাড়, কোথাও সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। প্রকৌশলীদের দক্ষতায় দুর্গম সব স্থানেও মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেক সেতু। এ রকমই পাঁচ সেতুর কথা।
দানিয়াং-কুনশান সেতু, চীন
চীনের দানিয়াং-কুনশান সেতুটিকে বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটির দৈর্ঘ্য ১৬৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। সেতুটি চীনের দুটি বড় শহর সাংহাই এবং নানজিংকে যুক্ত করেছে।
সেতুটি বেইজিং-সাংহাই হাই-স্পিড রেলওয়ের অংশে দানিয়াং এবং কুনশানকেও সংযুক্ত করেছে, যা বেইজিং পশ্চিম স্টেশন এবং সাংহাই হংকিয়াও স্টেশনকে সংযুক্ত করে।
কমপক্ষে ১০ হাজার কর্মী চার বছরে এটির নির্মাণ শেষ করেন। সেতুটির ৯ কিলোমিটার অংশ ইয়াংচেং হ্রদের ওপর বিস্তৃত। বড় এই অংশে সেতুটিকে সাপোর্ট দিচ্ছে ২ হাজার পিলার।
পুরো অবকাঠামোয় সাড়ে ৪ লাখ টন স্টিল ব্যবহার করায় এটি প্রবল টাইফুন এবং ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ সহ্য করতে পারে অনায়াসেই। পিলারগুলো এতটাই মজবুত যে তিন লাখ টন ওজনের নৌযানের ধাক্কাতেও কিছুই হয় না এই সেতুর।
সেতুতে উচ্চগতিসম্পন্ন ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা আছে। ট্রেনের গতি ২৫০-৩৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত তোলা যায়।
দ্য মিলিউ ভিয়াডাক্ট, ফ্রান্স
এই সেতুটিকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু সেতু হিসেবে বিবেচনা করা হতো। উচ্চতার দিক থেকে এটি আইফেল টাওয়ারকেও ছাড়িয়ে গেছে।
এটি একটি মাল্টি-স্প্যান কেব্ল-স্টেড ব্রিজ, যা টার্ন নদীর গর্জ উপত্যকার ওপর দিয়ে গেছে। সেতুটি ১ লাখ ২৭ হাজার কিউবিক মিটার কংক্রিট এবং ২৬ হাজার ২০০ টন রিইনফোর্সিং ইস্পাত দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ হাজার টন প্রি-স্ট্রেসড স্টিল কেব্লে পুরো সেতুটি ঢাকা।
এই সেতুর নকশার অন্যতম আকর্ষণ এটির স্প্যানগুলো অসামঞ্জস্যপূর্ণ ওজনের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। অতি উচ্চতার কারণে সেতুটি বাঁকানো। তাই পিলারগুলোকে প্রশস্ত এবং শক্তিশালী করে ডিজাইন করতে হয়েছে।
আকাশি কাইকিও সেতু, জাপান
জাপানের আকাশি কাইকিও সেতু বিশ্বের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতুগুলোর একটি। এটি ৩ হাজার ৯১১ মিটার দীর্ঘ। এটির সাপোর্ট টাওয়ারগুলো মাটি থেকে প্রায় ২৯৮ মিটার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে।
স্টিল ট্রাস স্ট্রাকচারে ডিজাইন করা পাইলনগুলো তারের স্যাডলকে টেনে সেতুর বেশির ভাগ লোড সাপোর্ট করে। পাইলনের মধ্যে দূরত্ব ১ হাজার ৯৯১ মিটার। এটিতে এমন দুই-স্তরের গার্ডার সিস্টেম আছে, যা সেতুর কাঠামোকে রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৫ পর্যন্ত ভূমিকম্প এবং ২৮৬ কিলোমিটার বেগের ঝোড়ো বাতাস থেকে রক্ষা করতে পারে।
এই বিশেষ সেতুতে বেশ কিছু উদ্ভাবনী প্রকৌশল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যার একটি হলো এটির প্রতিটি টাওয়ারে ২০টি টিউনড মাস ড্যাম্পার (টিএমডি)। টিএমডিগুলো সেতুকে বাতাসের দোলা থেকে রক্ষা করে।
যখন বাতাস সেতুটিকে একদিকে দেয়, তখন টিএমডিগুলো বিপরীত দিকে দোলে। এতে সেতুর ভারসাম্য বজায় থাকে।
আকাশি কাইকিও সেতুটি ‘পার্ল ব্রিজ’ নামেও পরিচিত। রাতে ২৮টি বিভিন্ন প্যাটার্ন এবং আলো সেতুটিকে আলোকিত করে।
ইনচিওন ব্রিজ, দক্ষিণ কোরিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচিওন ব্রিজ ১৩ কিলোমিটার লম্বা একটি সেতু। কেব্লে ঝোলানো ব্রিজের অংশটিকে কোরিয়ার দীর্ঘতম বিশ্বের দশম বড় ঝোলানো ব্রিজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার কেন্দ্রের মূল স্প্যান ৮০০ মিটার।
সেতুটির মূল উদ্দেশ্য হলো সোংদো এবং ইনচিওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন। শক্তিশালী ইঞ্জিনিয়ারিং সফটওয়্যার মিডাস সিভিল ব্যবহার করে সেতুটির নকশা এবং কাঠামো বিশ্লেষণ করা হয়।
এই সেতু ৭২ এমপিএস বায়ুসহ ঝড় এবং রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারে। সেতুটি ইনচিওন বন্দরের কাছে অবস্থিত। নিচে ৮০ মিটার উচ্চতাসহ ইউ আকৃতির ডিজাইন করা। এতে প্রধান দুটি টাওয়ারের মাঝ দিয়ে নিরাপদে জাহাজ পার হতে পারে। ইনচিওন ব্রিজের নিচের স্তম্ভ ৬ হাজার টন পর্যন্ত ওজন সহ্য করতে পারে, যা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে স্থিতিশীল সেতু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মাত্র আট মাসে সেতুর নির্মাণ শেষ হয়।
রুস্কি আইল্যান্ড সেতু, রাশিয়া
রুস্কি আইল্যান্ড সেতুটিকে বিশ্বের দীর্ঘতম কেব্ল সেতু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটির মোট দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ১০০ মিটার। টাওয়ারগুলোর মধ্যে দূরত্ব এক হাজার ৪ মিটার।
এই সেতুর নকশা নিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ এটি এমন একটি এলাকায় অবস্থিত যেখানকার আবহাওয়া চরম বৈরী।
ব্লাদিভোস্টকের আবহাওয়া মাইনাস ৪০ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠা-নামা করে। তাই এটির নির্মাণ ছিল শক্ত চ্যালেঞ্জের।
এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রকৌশলীরা মিডাস সিভিল সফটওয়্যার ব্যবহার করেন, যা তারের অপ্টিমাইজেশনের মাধ্যমে অজানা লোড ফ্যাক্টরগুলোর কাঠামোগত বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহার করা হয়।
কেব্ল সিস্টেমের জন্য কমপ্যাক্ট পিএসএস সিস্টেম নামে একটি উন্নত সিস্টেম ব্যবহার হয়েছে এটি নির্মাণে। এই সিস্টেমটি একটি কম্প্যাক্ট ডিজাইনের জন্য ব্যবহার করা হয়। ছোট ব্যাসের সঙ্গে খাপ খাওয়ার পাশাপাশি সেতুর কাঠামোতে বাতাসের গতি কমাতে সাহায্য করে এটি।
চরম তাপমাত্রার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য উচ্চ-ঘনত্বের পলিথিন (এইচপিডি) দিয়ে তৈরি প্রতিরক্ষামূলক কাভার ব্যবহার হয়েছে। এটি সেতুর কেবল-স্টেয়েড সিস্টেমের তারগুলোকে ঢেকে রাখে।