টুইট টাওয়ারে হামলার প্রায় দুই যুগ পেরিয়ে গেছে। প্রায় ২৪ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে চারটি যাত্রীবাহী প্লেন ছিনতাই করে সেগুলো দিয়ে আঘাত হানা হয় নিউইয়র্কের দুটি আকাশচুম্বী ভবনে। ওই ঘটনায় প্রাণ হারান কয়েক হাজার মানুষ। এই হামলা ছিল শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাগুলোর একটি। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, গোটা বিশ্ব চমকে গিয়েছিল ঘটনার ভয়াবহতায়।
এদিকে মার্কিন সাংবাদিক টাকার কার্লসন দাবি করেছেন, ইসরায়েলি গোয়েন্দারা যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার আগেই বিষয়টি সম্পর্কে জানতেন। একটি প্রামাণ্যচিত্র সিরিজে তিনি এ বিষয়সহ দীর্ঘদিন ধরে চাপা থাকা বহু তথ্যই সামনে আনবেন বলে জানিয়েছেন।
গত মঙ্গলবার কার্লসন পিয়ার্স মরগানের অনুষ্ঠান আনসেন্সরড নিউজে অংশ নিয়ে এমন মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ইসরায়েলের নেতৃত্ব কখনোই ৯/১১ হামলা নিয়ে তাদের মনোভাব লুকায়নি। বরং তারা মনে করত ওই হামলা যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করেছে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার ছিনতাইকারীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে একইসঙ্গে চারটি প্লেন ছিনতাই করে। তারপর সেগুলো ব্যবহার করে নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোতে আঘাত হানার জন্য বিশাল ও নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে। দুটি প্লেন বিধ্বস্ত করা হয় নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার ভবনে।
প্রথম প্লেনটি আঘাত হানে নর্থ টাওয়ারে স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে। দ্বিতীয় প্লেনটি সাউথ টাওয়ারে বিধ্বস্ত করা হয় এর কয়েক মিনিট পরেই, সকাল ৯টা ৩ মিনিটে।
হামলায় দুটি ভবনেই আগুন ধরে যায়। ভবন দুটির ওপরের তলাগুলোতে মানুষজন আটকা পড়ে যায়। শহরের আকাশে ছড়িয়ে পড়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। দুটি ভবনই ছিল ১১০ তলা। মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে সেগুলো বিশাল ধুলার ঝড় তুলে মাটিতে গুঁড়িয়ে পড়ে।
তৃতীয় প্লেনটি পেন্টাগনের সদর দপ্তরের পশ্চিম অংশে আঘাত হানে স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির উপকণ্ঠে ছিল মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর বিশাল এই পেন্টাগন ভবন।
এরপর, সকাল ১০টা ৩ মিনিটে চতুর্থ প্লেনটি আছড়ে পড়ে পেনসিলভেনিয়ার একটি মাঠে। ছিনতাই হওয়া চতুর্থ প্লেনের যাত্রীরা ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পর সেটি বিধ্বস্ত করা হয়। ধারণা করা হয়, ছিনতাইকারীরা চতুর্থ প্লেনটি দিয়ে ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে আঘাত হানতে চেয়েছিল।
ওই হামলার পরই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ক্যামেরার সামনে বলেছিলেন, এটা আসলে ভালো একটা ঘটনা। কারণ এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র এমন এক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে যা নিয়ে আমরা কয়েক দশক ধরে অস্তিত্বের লড়াই করছি।
২০০২ সালে মার্কিন কংগ্রেসে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, যুদ্ধে যেতে গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে কখনো কখনো ‘বোমা মেরে বাধ্য করতে হয়’। তিনি ৯/১১ হামলার সঙ্গে পার্ল হারবারে জাপানি হামলার তুলনা করেছিলেন।
কত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল?
এসব হামলায় সব মিলিয়ে মারা যায় ২ হাজার ৯৭৭ জন। এর মধ্যে অবশ্য ১৯ জন ছিনতাইকারী অন্তর্ভুক্ত নেই। নিহতদের বেশিরভাগই ছিলেন নিউইয়র্কের মানুষ। চারটি প্লেনের ২৪৬ জন যাত্রী ও ক্রুর প্রত্যেকেই মারা যান। টুইন টাওয়ারের দুটি ভবনে মারা যান ২ হাজার ৬০৬ জন। তাৎক্ষণিক ও পরে আঘাত থেকে পেন্টাগনের হামলায় প্রাণ হারান ১২৫ জন।
সর্বকনিষ্ঠ নিহতের বয়স ছিল মাত্র দু’বছর। নাম ক্রিস্টিন লি হ্যানসন। বাবা-মায়ের সঙ্গে একটি প্লেনের যাত্রী ছিল সে। নিহত সর্বজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির নাম রবার্ট নর্টন। তার বয়স ছিল ৮২। তিনি ছিলেন অন্য আরেকটি প্লেনে। স্ত্রী জ্যাকুলিনের সঙ্গে তিনি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন।
প্রথম প্লেনটি যখন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আঘাত করে, তখন ভেতরে আনুমানিক ১৭ হাজার ৪০০ জন লোক ছিল। নর্থ টাওয়ারের যে অংশে প্লেন আঘাত করে, তার উপরের কোনো তলার মানুষই প্রাণে বাঁচেনি। তবে সাউথ টাওয়ারে যেখানে প্লেন আঘাত করে, তার উপরের অংশ থেকে ১৮ জন প্রাণ নিয়ে বের হতে পেরেছিলেন। হতাহতের মধ্যে ৭৭টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষ ছিলেন। নিউইয়র্ক শহরে যারা প্রথম ঘটনাস্থলে জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় দৌড়ে যান, তাদের মধ্যে মারা যান ৪৪১ জন।
হাজার হাজার মানুষ আহত হন, যারা পরে নানা ধরনের অসুস্থতার শিকার হন। যেমন দমকলকর্মীদের অনেকে বিষাক্ত বর্জ্যের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
হামলাকারীদের সম্পর্কে কী জানা যায়?
উগ্র মতাদর্শের কথিত ইসলামপন্থি সংগঠন আল-কায়েদা আফগানিস্তান থেকে এই হামলার পরিকল্পনা করেছিল। ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বাধীন এই গোষ্ঠী মুসলিম বিশ্বে সংঘাত সৃষ্টির জন্য দায়ী করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোকে।
ছিনতাইকারী ছিল মোট ১৯ জন। এদের মধ্যে তিনটি দলে ছিল পাঁচজন করে, যারা প্লেন ছিনতাই করে হামলা চালায় টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে। আর যে প্লেনটি পেনসিলভেনিয়ায় ভেঙে পড়ে, তার ছিনতাইকারী দলে ছিল চারজন।
প্রত্যেক দলে একজন ছিনতাইকারীর পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষণ ছিল। এই ছিনতাইকারীরা তাদের পাইলটের ট্রেনিং নেয় যুক্তরাষ্ট্রেরই একটি ফ্লাইং স্কুলে। ১৫ জন ছিনতাইকারী ছিল সৌদি নাগরিক। এছাড়া দুজন সংযুক্ত আরব আমিরাতের, একজন মিসরের এবং একজন লেবাননের নাগরিক।
হামলার পর কী প্রতিক্রিয়া ছিল যুক্তরাষ্ট্রের?
এই হামলার এক মাসেরও কম সময় পর আল-কায়েদাকে নিশ্চিহ্ন করা এবং ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে বের করার ঘোষণা দিয়ে আফগানিস্তান আক্রমণ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এই অভিযানে যোগ দেয় আন্তর্জাতিক মিত্র জোট। যুদ্ধ শুরুর কয়েক বছর পর ২০১১ সালে মার্কিন সৈন্যরা অবশেষে ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পায় প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে এবং তাকে হত্যা করে।
নাইন ইলেভেন হামলার অভিযুক্ত পরিকল্পনাকারী খালিদ শেখ মোহাম্মদকে ২০০৩ সালে গ্রেপ্তার করা হয় পাকিস্তানে। এরপর থেকে তাকে গুয়ান্তানামো বের বন্দিশিবিরে মার্কিন তত্ত্বাবধানে বন্দি রাখা হয়েছে।
আল-কায়েদা এখনো টিকে রয়েছে। আফ্রিকায় সাহারা মরুভূমির দক্ষিণের দেশগুলোতে গোষ্ঠীটি সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী। তবে আফগানিস্তানের ভেতরেও তারা সক্রিয়। আক্রমণের প্রায় ২০ বছর পর ২০২১ সালে আফগানিস্তান ছেড়ে যায় পশ্চিমা বাহিনী। এরপর দেশটির ক্ষমতা দখল করে আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবান।