ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় সময়ের সঙ্গে উত্তাপ বেড়ে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের পরও বিক্ষোভে উত্তাল পুরো দেশ। চলমান বিক্ষোভে সোমবার ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই যে কাউকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাদের। শুধু তাই নয়, বিক্ষোভকারীরা সরকারি সম্পদ বিনষ্ট করার চেষ্টা করলে দেখামাত্র গুলি করারও নির্দেশ পেয়েছে তারা।
প্রেসিডেন্টের দেয়া বিশেষ ক্ষমতা ইতোমধ্যে প্রয়োগ শুরু করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের গুলিতে সোমবার থেকে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অন্তত ৭ জন নিহত হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার জানায়, সরকারি সম্পত্তি লুটপাট বা জীবনহানি ঘটালে যে কাউকে গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীকে। তবে অবস্থাদৃষ্টে ধারণা করা হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি ক্ষমতা প্রয়োগেও বিক্ষোভকারীরা পিছু হটছে না। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার পদত্যাগ দাবিতে তারা অনঢ়।
গত কয়েক মাস ধরেই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে চরম মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে, মুদ্রাস্ফীতিও আকাশছোঁয়া। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ।
এ অবস্থায় ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে দেশটির সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে। এক পর্যায়ে রাজাপাকসে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়।
বিক্ষোভ দমাতে এপ্রিলের শুরুতে রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা জারি করেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। কিন্তু প্রেসিডেন্টের এমন পদক্ষেপ বিক্ষোভ দমাতে ব্যর্থ হয়। উল্টো মাত্রা আরও তীব্র হয়।
বিক্ষুব্ধরা গত শুক্রবার পার্লামেন্ট ভবনে হামলার চেষ্টা করে। অনেক মন্ত্রী-এমপির বাড়ির সামনেও অবস্থান নিতে দেখা গেছে প্রতিবাদকারীদের।
সরকারি দলের সমর্থকরা এদিন বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে অন্তত ৭০ জন আহত হয়। এদিন রাতে দ্বিতীয়বারের মতো জরুরি অবস্থা জারি হয় শ্রীলঙ্কাজুড়ে।
এতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় সোমবার পদত্যাগ করেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। রাজধানী কলম্বোর তিন অংশে জারি হয় কারফিউ।
এই পর্যায়ে দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। নিহত হন এক এমপি। অনেক সাবেক মন্ত্রী-এমপির বাড়ি ও গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসের পৈতৃক বাড়িও জ্বালিয়ে দেয়া হয়। কারফিউ অমান্য করে মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে আবারও প্রতিবাদ শুরু করেন বিক্ষুব্ধরা।
শুরুর দিকে বিক্ষোভ অবশ্য শান্তিপূর্ণ ছিল। বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে তারা রাজাপাকসে সরকারের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছিল।
পুলিশের মুখপাত্র নিহাল থালডুয়া বলেন, কয়েক জায়গায় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হলেও মঙ্গলবারের পরিস্থিতি অনেকাংশে শান্ত হয়েছিল। সোমবার সংঘর্ষে অন্তত ২০০ জন আহত হন।
কলম্বো থেকে আল জাজিরার মিনেল ফার্নান্দেজ মঙ্গলবার বলেন, ‘রাজধানী শহরে বড় ধরনের সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। রাস্তায় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর একাধিক তল্লাশি চৌকিতে আমাদের থামতে হয়েছে।’
গোতাবায়া সরকারের সবশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সেনাবাহিনী আটকদের পুলিশে হস্তান্তরের আগে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত আটকে রাখতে পারবে। যে কোনো সময় কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে নিরাপত্তা বাহিনী তল্লাশি চালাতে পারবে।
মঙ্গলবার সরকারের এক গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার যে কোনো ব্যক্তিকে নিকটস্থ থানায় নেয়া হবে। সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এটি করার জন্য ২৪ ঘণ্টা বেঁধে দেয়া হয়েছে।’
নিরাপত্তা বাহিনী ক্ষমতার অপব্যবহার করলে তা দেখবে কে?
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দেয়া বিশেষ ক্ষমতা অপপ্রয়োগের আশঙ্কা করছেন অনেক বিশ্লেষক। কলম্বোভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভস থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের ভাবানি ফনসেকা বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে যেখানে জরুরি অবস্থা ও কারফিউ দুই-ই কার্যকর, সেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রশ্ন হলো, অপব্যবহার যে হবে না তা নিশ্চিত করবে কে?’
টানেলের শেষে নেই আলো
প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের পর এই ‘বিজয়’ উদযাপনে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। শুরুতে শান্তিপূর্ণ থাকলেও দ্রুতই পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে।
বিক্ষোভকারীরা কলম্বোর কেন্দ্রস্থলে রাজাপাকসের বাসভবন টেম্পল ট্রিসের গেটগুলো ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। মঙ্গলবার সকালে সেখানে ভাঙা কাঁচ এবং ফেলে যাওয়া জুতা রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
করোনা মহামারির জন্য ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। করোনায় দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান মাধ্যম পর্যটন খাতকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের পাশাপাশি এশিয়ান জায়ান্ট ভারত ও চীনের সহায়তা চাইছে শ্রীলঙ্কা।
এমপিদের আটকাতে বিমানবন্দরে বিক্ষুব্ধদের অবস্থান
গণবিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের পর শ্রীলঙ্কার সংসদ সদস্যদের দেশত্যাগ ঠেকাতে বিমানবন্দরের প্রবেশমুখে অবস্থান নিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।
শ্রীলঙ্কাভিত্তিক ডেইলি মিররের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদল বিক্ষুব্ধ তরুণ কাতুনায়েকে মুক্তবাণিজ্য জোনে (এফটিজেড) অবস্থান নিয়েছেন। তাদের অবস্থান নেয়া সড়কটি দিয়েই বন্দরনায়েক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে প্রবেশ করতে হয়।
বিক্ষোভকারীরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর যাতে সংসদ সদস্যরা দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সে জন্য তারা বিমানবন্দরের প্রবেশমুখে সড়কে অবস্থান নিয়েছেন।
হেলিকপ্টারে ‘পালিয়েছেন’ মাহিন্দা রাজাপাকসে
শ্রীলঙ্কায় বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়া মাহিন্দা রাজাপাকসের খোঁজ মিলছে না। সপরিবারের তিনি কোথাও পালিয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে।
সোমবার পদত্যাগ করেন মাহিন্দা, এরপর থেকে রাজধানী কলম্বোতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনেই ছিলেন তিনি। তবে মঙ্গলবার ভোরে সূর্য ওঠার আগেই সেনাবাহিনী তাকে সেখান থেকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছে।
একটি সূত্রের বরাত দিয়ে এনডিটিভি বলছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ত্রিনকোমালিতে একটি নৌ ঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন মাহিন্দা ও তার পরিবারের সদস্যরা। হেলিকপ্টারে করে সেখানে পৌঁছেছেন তারা।
কলম্বো থেকে ২৭০ কিলোমিটার দূরের এ নৌ ঘাঁটিতে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা যখন আশ্রয় নেন, তখন ঘাঁটিটির সামনে চলছিল বিক্ষোভ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পদ ছাড়ছেন না প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া
সংকটের মুখে পড়ে পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের জায়গায় নতুন একজনকে নিয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে।
ফিন্যানশিয়াল টাইমস মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
নিজে পদে থেকেই নতুন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ দিতে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। এর মাধ্যমে তার পদ ছাড়া নিয়ে যে দাবি উঠেছে, তাতে তার সাড়া না দেয়ার স্পষ্ট বার্তা এলো।
সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য, এমন ব্যক্তিই শ্রীলকে নতুন মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে বলে জানিয়েছেন গোতাবায়া রাজপাকসে।