বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষের কাছে ২০২০ সালটি ছিল ‘জঘন্য’। করোনা মহামারি, চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা, আবহাওয়া বিপর্যয় এবং জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল দুই বছর আগে। তবে ইতিহাসে এটিই কি সবচেয়ে বাজে বছর?
উত্তর, না। এর চেয়েও ভয়াবহ সময় পার করেছে মানুষ। ইতিহাসবিদ এবং প্রত্নতাত্ত্বিক মাইকেল ম্যাককর্মিকের দৃষ্টিতে বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ‘খারাপ বছর’ ছিল ১ হাজার ৪৮৬ বছর আগে ৫৩৬ সাল।
১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির বছরে মহামারি স্প্যানিশ ফ্লু ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বজুড়ে। এতে প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত পাঁচ কোটি মানুষ।
তারও আগে ১৩৪৯ সালে ব্ল্যাক ডেথে বড় ধরনের প্রাণহানি দেখেছিল ইউরোপ। সে বছর প্লেগে মারা পড়েছিল মহাদেশটির প্রায় অর্ধেক মানুষ। ধারণা করা হয় সংখ্যাটা ২ কোটি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতিটা বছরই অবশ্য ‘সবচেয়ে বাজে বছর’ আখ্যা পাওয়ার দাবি রাখে। তবে ৫৩৬ সালটি ছিল সবচেয়ে আলাদা।
কী ঘটেছিল ৫৩৬ সালে?
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির মধ্যযুগীয় ইতিহাসের অধ্যাপক ম্যাককর্মিকের মতে, ৫৩৬ সাল ছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময়ের শুরুর বছর।
বছরের শুরুর দিকে আইসল্যান্ডে একটি আগ্নেয়গিরি থেকে ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল। ম্যাককর্মিক এবং হিমবাহবিদ পল মায়েউস্কি সুইস হিমবাহের ওপর একটি গবেষণা চালিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হন। মায়েউস্কি যুক্তরাষ্ট্রের মেইন বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউএম) ক্লাইমেট চেঞ্জ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক।
তাদের দাবি, আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত ছাইয়ের মেঘে সম্ভবত গোটা আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল। যার প্রভাবে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার কিছু অংশ প্রায় দেড় বছরের জন্য অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়।
বাইজেন্টাইন ইতিহাসবিদ প্রকোপিয়াস এ পরিস্থিতির বর্ণনায় লিখেছিলেন, ‘সূর্য সারা বছর চন্দ্রের মতো উজ্জ্বলতা ছাড়াই আলো দিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে সূর্য গ্রহণের মধ্যে আছে।’
সেই সময়ের এক রোমান রাজনীতিবিদ ক্যাসিওডোরাস লিখেছিলেন, ‘সূর্য “নীল” বর্ণ ধারণ করেছিল। চাঁদের কোনো দীপ্তি ছিল না। মৌসুমগুলো সব এক হয়ে গেছে বলে মনে হয়। দুপুরে নিজের ছায়া দেখতে না পেয়ে আমরা অবাক হই।’
পরিস্থিতি ধাবিত হয় দুর্ভিক্ষের দিকে
টানা অন্ধকার একসময় আবহাওয়াকে শীতল করে তোলে। গ্রীষ্মের তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে আড়াই ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমে গিয়েছিল; যার ফলে গত ২৩০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শীতল দশক শুরু হয়। বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল সায়েন্স-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, এই অবস্থা ফসল ধ্বংস এবং বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার পরিস্থিতি তৈরি করে।
একটি সাম্রাজ্যের পতন
এই বিপর্যয় আরও ভয়াবহ রূপ নেয় ৫৪১ সালে। সে বছর ‘মড়ার ওপর খাড়ার ঘা’ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ‘বিউবনিক প্লেগ’। মিশর উপত্যকার রোমান বন্দর থেকে ছড়িয়েছিল এই অতিসংক্রামক রোগ। এটি ‘প্লেগ অফ জাস্টিনিয়ান’ নামেও পরিচিত। এতে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের প্রায় অর্ধেক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। পতন হয়েছিল একটি দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসন ব্যবস্থার।
পরিবেশগত বিপর্যয়ের জন্য ৫৪০ এবং ৫৪৭ সালও আলোচিত। ওই দুই বছরে বড় ধরনের অগ্ন্যুৎপাত দেখেছিল বিশ্ব। এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে আবার প্রাদুর্ভাব ঘটে প্লেগের। ইউরোপ পরবর্তী শতাব্দীর প্রায় অর্ধেকই অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে ছিল। ৬৪০ সালে খনি থেকে রুপা উত্তোলন শুরুর আগ পর্যন্ত এটির জের টেনেছিল ইউরোপবাসী।
এটা কি ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময়?
ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে সময় নির্ভর করে সেই সময়টায় আপনি কে ছিলেন এবং কোথায় থাকতেন, তার ওপর।
নেটিভ আমেরিকানরা অবশ্য ১৫২০ সালকে সবচেয়ে বাজে বছর দাবি করতে চাইবেন। সে বছর স্প্যানিশদের কাছ থেকে ছড়ানো গুটিবসন্তে লাখ লাখ আমেরিকান আদিবাসীর মৃত্যু হয়।
এ ছাড়া ১৬০০ সালে ইউরোপীয় রোগজীবাণুতে আক্রান্ত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ (প্রায় ৫ কোটি ৫০ লাখ)।
সবশেষে বলা যায়, ‘সবচেয়ে খারাপ বছর’ শিরোনামটি আদতে নির্ভর করে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণের ওপর।