ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। ২ কোটি জনসংখ্যার এই দেশটিতে নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামে বিপর্যন্ত জনজীবন।
আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি, দুর্বল সরকারি অর্থব্যবস্থা এবং করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। এতে লঙ্কান সরকারের অন্যতম রাজস্ব আয়ের খাত পর্যটনশিল্প ধসে পড়েছে, বিদেশি রেমিট্যান্স পৌঁছেছে তলানিতে। আর এর প্রভাবে নিত্যপণ্যের দাম গত এক মাসে কয়েক ধাপে ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
কলম্বোর বাসিন্দা শারিন সিলভা পেশায় মেকআপ আর্টিস্ট। বেশ ভালোই চলছিল ব্যবসা। তবে অর্থনৈতিক এই বিপর্যয়ে তিনি এখন দিশেহারা। মেকআপের সরঞ্জাম কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন শারিন।
শারিন বলেন, ‘চায়ের জন্য তরল বা গুঁড়া দুধ নেই। শিশুর দুধের ফর্মুলার দাম আকাশচুম্বী। মনে হচ্ছে দেশে যুদ্ধ চলছে। খাবারের জন্য রেশন করতে হবে।’
খাদ্য ও জ্বালানির ঘাটতি
গত কয়েক বছরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতি বেশ টালমাটাল ছিল। এই অবস্থায় দেশের বিদেশি মুদ্রা রিজার্ভ নাটকীয়ভাবে কমে এসেছে। ২০২০ সালে শুরুর দুই মাসে রিজার্ভ ৭০ শতাংশ কমে যায়। ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে বিদেশি মুদার রিজার্ভ দাঁড়ায় ২.৩ বিলিয়ন ডলারে! শুধু তা-ই না, বছরের বাকি সময়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিতে হয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকারকে।
আরও সংকট অপেক্ষায়
আমদানি পণ্যের ওপর অনেকটাই নির্ভর করতে হয় শ্রীলঙ্কাকে। খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের পাশাপাশি কাগজ-কালি আমদানি করে থাকে দেশটি। এর এসবের বিনিময় হয় ডলারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মুদ্রায়।
শ্রীলঙ্কার অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, তাদের কাছে এখন যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা আছে, তা দিয়ে আর এক মাস পণ্য আমদানি করা যাবে।
অর্থের বিনিময়েও জ্বালানি কিনতে বেগ পেতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের। জ্বালানির জন্য দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষার সময় প্রাণ গেছে কয়েকজনের।
অন্যদিকে, থার্মাল জেনারেটরের তেলের ঘাটতিতে এলাকাভিত্তিক সংকোচনমূলক বিদ্যুৎ সরবরাহের কৌশল নিয়েছে সরকার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাকে আরও বেশি সংকটে ফেলেছে। সম্প্রতি দেশটিতে জ্বালানির দাম কয়েক দফায় লিটারে বেড়েছে ২০ শতাংশ।
কাগজের সংকটে বন্ধ হচ্ছে সংবাদপত্রের প্রকাশনা, বাতিল হয়েছে স্কুলের পরীক্ষা। ভয়াবহ মন্দায় প্রাণ বাঁচাতে সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতের তামিলনাড়ুতে আশ্রয় নিচ্ছেন অনেকে।
প্রসাদ ওয়েলিকুম্বুরা নামের এক সমাজকর্মী বলেন, ‘দৈনিক মজুররা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ট্রাক ও ট্যাক্সিচালকদের অবস্থা ভয়াবহ।’
শুল্ক কমানোয় চাপ বেড়েছে জনগণের ওপর
শ্রীলঙ্কায় এই অর্থনৈতিক মন্দার জন্য সরকারকেই দুষছে জনগণ। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর আশ্বাসে ২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন গোটাবায়া রাজাপাকসে।
নির্বাচনি প্রচারে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে অর্ধেক করা হবে। বাতিল করা হবে আরও কিছু শুল্ক।
শুল্ক কমানোর ফলে বিলিয়ন রুপির ক্ষতি হয়েছে সরকারের। বিদেশি ঋণ পরিশোধে চাপ বেড়েছে শ্রীলঙ্কানদের ওপর।
এর মধ্যে হানা দিল করোনা। এতে ভেঙে পড়ে পর্যটনশিল্প। এই খাত থেকে দেশের মোট অর্থনীতির ১২ শতাংশ আয় করে সরকার।
ফ্রন্টিয়ার রিসার্চ গ্রুপের অর্থনীতিবিদ চানু দামসিংহে বলেন, ‘কর কমানো এবং পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে আরও অর্থ যোগ করার সিদ্ধান্তই সংকটকে ভয়াবহ করে তুলেছে।
উদ্ধারে এগিয়ে আসবে কে?
অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে ‘খুব প্রয়োজনীয় নয়’ এমন সব পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে লঙ্কান সরকার। সাহায্যের জন্য রাজাপাকসে সরকার যোগাযোগ করছে ভারত ও চীনের সঙ্গে।
চলতি মাসের শুরুতে বাকিতে ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করতে দিল্লির সঙ্গে চুক্তি করেন শ্রীলঙ্কান অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসে। বাকিতে আরও ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য চেয়েছে কলম্বো। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে কলম্বো সফরে যাচ্ছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
ঋণের পাশাপাশি ভারত এ বছর ৪০০ মিলিয়ন ডলারের ‘কারেন্সি সোয়াপ’ (মুদ্রা বিনিময়) এবং জ্বালানি তেল কেনার জন্য আরও ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে শ্রীলঙ্কাকে।
চীনের কাছ থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধের জন্য সময় চেয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। আরও ২.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণের জন্য বেইজিং-কলম্বোর আলোচনা চলছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শ্রীলঙ্কাকে হয় তার ঋণ পুনর্গঠন করতে হবে, নতুবা একটি ত্রাণ প্যাকেজ নিয়ে আলোচনার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দরজায় কড়া নাড়তে হবে।
শুরুর দিকে আইএমএফ-এর দারস্থ না হওয়ার বিষয়ে অটল থাকলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় অবস্থান বদলেছে রাজাপাকসে সরকার। তারা এখন আইএমএফের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সংকট নিরসনে এপ্রিলে ওয়াশিংটন সফর করবেন রাজাপাকসে।