রাশিয়ার নাম আসলেই আলোচনায় আসে তাদের জ্বালানি তেলের কথা। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্ব নেতাদের ওপর প্রভাব খাটানোর যে চেষ্টা করেন; তার পেছনে বড় একটা কারণও এই তেল।
পুতিন হয়তো ভেবেই নিয়েছিলেন; তেল-গ্যাস-কয়লার কথা চিন্তা করে ইউক্রেনে তাদের চালানো হামলা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবে না। তবে তা আর হয়নি। ইউক্রেন হামলা শুরুর পর দেশটির এসব পণ্যের ওপর এসেছে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা।
যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পর সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেল রপ্তানি করে রাশিয়া। প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিতেও দেশটির অবস্থান শীর্ষে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, রাশিয়ার তেল ছাড়া কি বিশ্বের চলবে?
এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির বুধবারের এক প্রতিবেদনে।
রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা
রাশিয়ার তেল-গ্যাস-কয়লার ওপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জো বাইডেনের প্রশাসন জানিয়েছে, ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ থেকে এসব পণ্য আমদানি করবে না তারা।
এর আগে যুক্তরাজ্যও একই নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয়। তারা বলছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়ান তেল পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা হবে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, তারা গ্যাস আমদানি দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনছে।
রাশিয়ার তেলের বিকল্প উৎস খোঁজার কথা জানিয়েছে যুক্তরাজ্য।
অবশ্য তেল নিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রসঙ্গে বরবারের মতোই শক্ত কথা বলেছে রাশিয়া। দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী আলেকজ্যান্ডার নোভাক বলেন, রাশিয়ান তেলের ওপর দেয়া নিষেধাজ্ঞা বিশ্ববাজারে বিপর্যয়মূলক অবস্থা ডেকে আনবে।
সার্বিক পরিস্থিতিতে রাশিয়া তেল রপ্তানি বন্ধ করলে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে শুরু করবে বিশ্বজুড়ে। এরই মধ্যে এসব পণ্যের দাম হুহু করে বেড়ে ওঠায় তেমনই ইঙ্গিত মিলছে।
কী পরিমাণ তেল রপ্তানি করে রাশিয়া
তেল উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পর তৃতীয় বৃহত্তম দেশ হলো রাশিয়া। প্রতিদিন দেশটি প্রায় ৫০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে। এর অর্ধেকের বেশি যায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। যুক্তরাজ্যের চাহিদার ৮ ভাগ তেল রপ্তানি করে রাশিয়া।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যের চেয়ে রাশিয়ার ওপর কিছুটা কম নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদার মোট ৩ ভাগ তেল আসে রাশিয়া থেকে।
ব্লুমবার্গের তথ্য বলছে, দিনে সাড়ে ১৬ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করে যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে সৌদি আরব করে ১১ মিলিয়ন ব্যারেল, আর রাশিয়া করে ১০ দশমিক ৭ মিলিয়ন ব্যারেল। কানাডা ৫ দশমিক ১, ইরাক ৪ দশমিক ১, চীন ৩ দশমিক ৯ আর কুয়েত উৎপাদন করে ২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন।
বিকল্প কী
জ্বালানি নীতি গবেষণা বিশ্লেষক বেন ম্যাকউইলিয়ামস বলেছেন, গ্যাসের চেয়ে বরং বিকল্প তেল সরবরাহকারী খুঁজে পাওয়া সহজ হওয়া উচিত। তিনি বলেন, রাশিয়া থেকে কিছু তেল আসছে। তবে অন্য দেশগুলো থেকেও এর প্রচুর চালান রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সৌদি আরবকে তেলের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বলা হচ্ছে। তবে তেলের দাম কমানোর জন্য উৎপাদন বাড়ানোর এই প্রক্রিয়ায় সমর্থন নেই তাদের। সৌদির পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ প্রত্যখ্যান করা হয়েছে।
তেল রপ্তানিকারকদের সংগঠন ওপেকের বৃহত্তম উত্পাদক দেশ সৌদি আরব। এই সংগঠনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে অপরিশোধিত তেলের প্রায় ৬০ ভাগ বিক্রি করা হয়ে থাকে। তেলের দাম প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে ওপেকের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে।
রাশিয়া ওপেকের অন্তর্ভুক্ত না হলেও উত্পাদকদের আয় বজায় রাখার জন্য ২০১৭ সাল থেকে এর সঙ্গে কাজ করছে রাশিয়া।
তেল নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র এখন তাকিয়ে আছে ভেনেজুয়েলার তেল নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার দিকে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রে প্রধান তেল সরবরাহকারী ছিল, কিন্তু সম্প্রতি তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মূলত চীনের কাছে তাদের তেল বিক্রি করছে।
রাশিয়া গ্যাস না পাঠালে কী হবে
রাশিয়ার গ্যাস না পেলে পশ্চিম ইউরোপে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। এরই মধ্যে এসব দেশে দাম বাড়তে শুরু করেছে গ্যাসের, যা আরও বাড়বে।
ইউরোপে যে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি হয়, তার প্রায় ৪০ ভাগই আসে রাশিয়া থেকে। ইউক্রেন সংকটে এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে বিশেষ করে সংকটে পড়বে ইতালি ও জার্মানির মতো দেশগুলো।
যুক্তরাজ্য ৫ শতাংশ গ্যাস আমদানি করে রাশিয়ায় থেকে। আর যুক্তরাষ্ট্র দেশটি থেকে কোনো গ্যাসই আমদানি করে না। এসব দেশে দাম বাড়ছে মূলত সরবরাহের ঘাটতির কারণে।
রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প আছে?
রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প এখনও সে রকম গড়ে ওঠেনি। তবে উপায় খুঁজছে অনেক দেশই।
বিশ্লেষক বেন ম্যাকউইলিয়ামস বলছেন, রাশিয়ার গ্যাসের বিকল্প খোঁজা কঠিন। রাশিয়ান গ্যাস ইউরোপে চলে যাচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপকে রাশিয়ান জ্বালানি মুক্ত করতে একটি পরিকল্পনা দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধে তেল-গ্যাস আমদানি করা দেশগুলো অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভোক্তাদের খরচ বেড়েছে। শিগগিরই হয়তো তাদের আরও বেশি অর্থ গুনতে হবে এসব পণ্য কিনতে।
ইউক্রেন সীমান্তে টানা কয়েকদিন সেনা মোতায়েন করে রেখে অবশেষে গত ২৪ ফ্রেব্রুয়ারি দেশটিতে হামলা চালানো শুরু করে রাশিয়া। পুতিন বাহিনীকে প্রতিরোধ করছে ইউক্রেনের সেনারাও।
এরই মধ্যে তিন দফা ইউক্রেন-রাশিয়ার বৈঠক হয়েছ; তবে কার্যত যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
ইউক্রেনে হামলা শুরুর আগেই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্থির হতে শুরু করে।
সর্বশেষ মঙ্গলবার অশোধিত তেল ১৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। ব্যারেল প্রতি দাম উঠেছে ১৩০ ডলারে। আর বিভিন্ন পাম্পে পেট্রলের দাম সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে প্রতি গ্যালন গড়ে ৪ দশমিক ১৭ ডলারে বিক্রি হয়।