ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের মধ্যেই দেশটিতে অবস্থিত ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র জাপোরিজ্জাতে হামলা চালিয়েছে রুশ সেনারা। ইউক্রেন বলছে, রুশ ট্যাঙ্কের হামলার পর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লিতে আগুন ধরে গেছে।
দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবা জানিয়েছেন, এই কেন্দ্রের চুল্লি গলে যাওয়া চেরনোবিলের থেকে ১০ গুণ বেশি ভয়াবহ হতে পারে।
এর আগে ১৯৮৬ সালে ইউক্রেনের চেরনোবিলে সোভিয়েত আমলে এক পারমাণবিক দুর্ঘটনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। পারমাণবিক প্রযুক্তির ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা।
২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর ২০ বছরে তেজস্ক্রিয়তার পরোক্ষ প্রভাবে প্রায় ৪ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
শুক্রবার ইউক্রেনের জাপোরিজ্জা চুল্লিতে রুশ হামলার পর এই শঙ্কা ফিরে এসেছে, ইউরোপ কি আরেকটি চেরনোবিলের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে?
পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলার পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ‘জাপোরিজ্জার পরিস্থিতি চেরনোবিলের বিপর্যয়ের থেকেও খারাপ হবে।’
তিনি সাধারণ ইউরোপীয়দের অনুরোধ করে বলেন, ‘ইউরোপীয়রা, দয়া করে জেগে উঠুন। আপনাদের রাজনীতিবিদদের বলুন, রুশ সেনারা ইউক্রেনের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে গুলি করেছে।’
পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে চেরনোবিল শহর। ছবি: সংগৃহীত
জেলেনস্কি আরও বলেন, রুশ প্রপাগান্ডা এর আগেও সতর্ক করেছে। কিন্তু এখন এটি বাস্তব, বিশ্বকে এরা পারমাণবিক ছাইয়ে ঢেকে দেবে। এখন আর সতর্কতা নয়, বাস্তব।
তবে আপাতত এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।
তাদের মতে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলার ঘটনা বিপজ্জনক হলেও চেরনোবিল ও জাপোরিজ্জার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের লন্ডন ইম্পেরিয়াল কলেজের বিশেষজ্ঞ ড. মার্ক ওয়েনম্যানের মতে জাপোরিজ্জা চেরনোবিলের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ।
তিনি জানান, এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লিগুলো স্টিল ও কংক্রিট দিয়ে মোড়ানো। এগুলো প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট যেকোনো বিপর্যয়ের চাপ নিতে সক্ষম। এছাড়া জাপোরিজ্জার চুল্লিতে কোনো গ্রাফাইট নেই।
মার্ক ওয়েনম্যান জানান, গ্রাফাইটের উপস্থিতির কারণেই চেরনোবিলে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল। এর পরেই চুল্লি গলে তেজক্রিয় বিকিরণ ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
তবু কাটছে না শঙ্কা
গ্রাফাইট না থাকলেও জাপোরিজ্জা থেকে বিকিরণ ছড়িয়ে পড়বে না এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা।
ইউক্রেনে জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করা সংগঠন ইকো-অ্যাকশনের ডেপুটি ডিরেক্টর অলেক্সি পাসিউক বলেন, ‘কোনো পারমাণবিক কেন্দ্রে ঝামেলা তৈরির জন্য সরাসরি আঘাতের দরকার পড়ে না। কেন্দ্রের জ্বালানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলেও বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে।’
বিবিসি জানিয়েছে, ইতোমধ্যে রুশ গোলা হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ কেন্দ্রের চুল্লিগুলো বন্ধের চেষ্টা চালাচ্ছেন ইউক্রেনীয়রা। ছয়টি চুল্লির মধ্যে মাত্র একটি এখন চালু রয়েছে।
প্রথাগত জ্বালানি কেন্দ্রের চেয়ে কিছুটা ভিন্নভাবে কাজ করে পারমাণবিক চুল্লি। এগুলো হুট করে বন্ধ করা যায় না। চুল্লি ঠাণ্ডা হতে ৩০ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। এজন্য নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রয়োজন হয়। কোনো কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে চুল্লি ঠান্ডা করতে ঝামেলা হতে পারে। এসময় তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ারও ঝুঁকি তৈরি হয়।
ইউনিভার্সিটি অফ শেফিল্ডের অধ্যাপক ও পরমাণু বিশেষজ্ঞ ক্লেইরে কর্কহিল বিবিসিকে বলেন, ‘জাপোরিজ্জাতে সবচেয়ে খারাপ যা ঘটতে পারে, সেটি হলো চুল্লিগুলোকে ঠান্ডা করার প্রক্রিয়া কাজ না করা। ২০১১ সালে সুনামির সময় জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক কেন্দ্রেও এমন ঘটনা ঘটেছিল।’বন্ধ হয়ে যাওয়া চেরনোচিল ছাড়াও ইউক্রেনে চারটি সচল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া পরমাণু বর্জ্য সংরক্ষণের জন্যও বেশ কিছু কেন্দ্র রয়েছে দেশটিতে।
২৭ ফেব্রুয়ারি কিয়েভের এমন একটি কেন্দ্রেও মিসাইল হামলা চালিয়েছে রাশিয়া।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, জাপোরিজ্জাতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দখলে নিয়েছে রুশ বাহিনী। তবে এখনও কন্ট্রোল রুমে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন ইউক্রেনীয় কর্মীরা।
এমন পরিস্থিতিতে খুব আশ্বস্ত নন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) ডিরেক্টর জেনারেল রাফায়েল মারিয়ানো গ্রসি।
তিনি বলেন, ‘ আমি খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা জানি না এটি কীভাবে ঘটল। এই ঘটনা খুব নাটকীয় হতে পারে। ফের এমন কিছু ঘটার জন্য আমাদের অপেক্ষায় থাকা ঠিক হবে না।’
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে অভিযান চালানোর সময় যেন সতর্কতা নেয়া হয় সে বিষয়ে রুশ বাহিনীর সঙ্গে কথা বলতে ইউক্রেন সফরের পরিকল্পনা করছেন মারিয়ানো গ্রসি।
২০১৪ সালে রাশিয়া সমর্থিত বিদ্রোহীরা ইউক্রেনের কয়লা সমৃদ্ধ অঞ্চল ডনবাসের দখল নেয়। কয়লা থেকে নিজেদের জ্বালানির ৪১ শতাংশ চাহিদা মেটাত ইউক্রেন।
এ ঘটনার পর চারটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রই ইউক্রেনের জ্বালানির ভরসা হয়ে উঠেছে।