ভালোবাসা, মানুষের জীবনে এক আশ্চর্য অনুভূতির নাম। ভালোবাসা হয়ও বিভিন্ন ধরনের। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা, প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা। এই ভালোবাসা নিয়ে হয়েছে যুদ্ধ, ধ্বংস হয়েছে নগরী। লেখা হয়েছে অজস্র কবিতা, গাওয়া হয়েছে গান। ভালোবাসার সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়েছে চিত্রকলায়, চলচ্চিত্রে। জীবনের অনেকটা সময় আমরা ভালোবাসা নিয়েই ভাবি।
ভালোবাসা যেমন মানবজীবনে সহজাত, তেমনি বৈচিত্র্যপূর্ণ। যেমন সঙ্গী কিংবা সঙ্গিনীর প্রতি ভালোবাসা অন্যান্য প্রাইমেটের মধ্যে দেখা গেলেও একমাত্র প্রাইমেট হলো মানুষ, যে প্রজাতির পুরুষরাও সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ব বোধ অনুভব করে।
সাংবাদিক হিসেবে দিনের অনেকটা সময় ব্যস্ততায় কাটাতে হয় আজহারুল ইসলামকে। তিনি এক সন্তানের বাবা। একটু অবসরেও তার মনে হয়, তার শিশু সন্তানটি কী করছে, ঠিকমতো খেয়েছে কি, সে কি ঘুমিয়েছে। বাসায় ফিরলেই সন্তানকে তিনি বুকে টেনে নেন। এমনটাই স্বাভাবিক কিন্তু প্রাইমেটের বিচারে এটি খুবই ব্যাতিক্রম ঘটনা।
আমাদের চেনাজগৎ পর্যবেক্ষণে আমরা ইতিমধ্যেই জানি, মানুষের জীবনে ভালোবাসা থাকবেই। কারণ শরীরের প্রাণরসায়ন ও মনস্তাত্ত্বিক জগৎই আসলে নিশ্চিত করে যে আমরা কাউকে না কাউকে ঠিকই ভালোবাসব। কিন্তু প্রেমিক অথবা প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসা এলো কোথা থেকে? অনেকেই ভেবে থাকেন ভালোবাসার আগমন বুদ্ধিমত্তা থেকে, আবার অনেকেই ভাবেন ভালোবাসা আসে হৃদয় থেকে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো বিবর্তনের ধারায় ভালোবাসা ও বুদ্ধিমত্তা, অনেক উপাদানই তারা একে অপরের সঙ্গে আদান-প্রদান করেছে। ফলে আমাদের পূর্বপুরুষ হয়েছে আরও বুদ্ধিমান এবং তাদের মস্তিষ্ক হয়েছে আরও বড়।
প্রকৃত অর্থে ভালোবাসার বন্ধন ছাড়া এমনটি সম্ভব হতো না। মানবশিশু অন্যান্য প্রাণীর মতো শক্ত-সমর্থ হয়ে জন্মায় না। তাই জন্মের পর তার প্রয়োজন হয় ভালোবাসা, অত্যধিক স্নেহ ও মনোযোগ। একজন স্বাধীন মানুষ হয়ে উঠতে তাকে অনেক কিছু শিখতে হয়। এ জন্য তাকে নির্ভর করতে হয় তার মা-বাবার ওপর। জীবনের একটা দীর্ঘসময় সন্তানের দিকে মা-বাবার খেয়াল রাখতে হয়। ভালোবাসাই মানুষকে পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধ ও দায়িত্বশীল করেছে। নিশ্চিত করেছে একে অপরের পাশে থাকা।
ফলে অন্যান্য প্রাইমেটের থেকে শিশুদের বেড়ে ওঠার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে মহাদেশ থেকে মহাদেশে।
প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে ভালোবাসা আমাদের মস্তিষ্কের সঙ্গেও চালাকি করেছে। যখন মানুষ ভালোবাসে তখন মস্তিষ্কে ডোপামিন হরমোন ক্ষরণ হয়। এই ডোপামিন হরমোন আমাদের এক ধরনের আনন্দের অনুভূতি দেয়। মানুষের ভালোবাসা যত গভীর হয় মস্তিষ্ক আরও বেশি মাত্রায় ডোপামিন হরমোন ক্ষরণ করে মানুষকে পুরস্কৃত করে।
বিবর্তন ঠিক এই অভিজ্ঞতাকেই রোমান্টিক ভালোবাসায় পরিণত করেছে। একজন মা যখন তার সন্তানকে জড়িয়ে ধরে তখন অক্সিটোসিন হরমোন ক্ষরণ হয়। ঠিক একই ঘটনা ঘটে যখন প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে। এই অক্সিটসিনকে ‘লাভ হরমোন’ বলা হয়। এই হরমোনই একটি সম্পর্ককে দীর্ঘরূপ দেয়।
এই রোমান্টিক ভালোবাসা আমাদের পূর্ব পুরুষকে বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছে। একমাত্র প্রাইমেট হিসেবে মানুষ, যাদের পুরুষরাও সন্তানের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে।
তারাও মায়েদের সাহায্য করে সন্তানকে লালন-পালন করতে। সন্তানকে বিপদমুক্ত রাখতে মায়ের পাশাপাশি সেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শুধু সন্তানের দেখভাল করে প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধিতেই অবদান রাখেনি, এই ভালোবাসাই মানুষের একসঙ্গে কাজ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে এবং সামাজিক বুদ্ধিমত্তাতেও প্রভাব ফেলেছে।
যেমন দেখা গেছে সঙ্গী-সঙ্গিনীর মা, ভাই, বোন ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগের প্রবণতা ভালোবাসার প্রয়োজনেই মানুষকে বাড়াতে হয়েছে, যা মানুষের মস্তিষ্ককে বৃদ্ধি করেছে। ফলে মানুষ ভাষার উন্নতি করতেও সক্ষম হয়েছে।
এই ভালোবাসার জন্যই মানুষের মস্তিষ্ক একটি প্রিমিটিভ পর্যায় থেকে জটিল মস্তিষ্কে রূপান্তরিত হয়েছে।
এখন আর মানুষের এত প্রতিকূলতা নেই, ছেলেমেয়েদের বড় করা এখন আগের থেকে অনেক সহজ, খাবারের জন্য এখন আর শিকারের প্রয়োজন নেই, গুহাকে হিংস্র পশুর হাত থেকেও রক্ষা করার প্রয়োজন নেই। তাহলে আমাদের মস্তিষ্ক থেকে কি ভালোবাসা হারিয়ে যাবে?
প্রশান্তির বিষয় এই যে, মস্তিষ্ক থেকে ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ভালোবাসার জন্ম হয়েছে, থেকে যাওয়ার জন্য। এখনও আমাদের মস্তিষ্কের পুরস্কারের প্রত্যাশার অবস্থান থাকা অংশ ট্যাগমেন্টাল অঞ্চল ও ভয়ের প্রবণতা দেয়া অঞ্চল অ্যামিগোলিয়ায় এখনও ভালোবাসা প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
হাজার হাজার বছর ধরে আমরা এখনও ভালোবাসার প্রত্যাশা করি। ভালোবাসাই আমাদের মানুষ হিসেবে বাঁচিয়ে রেখেছে।