দুই বছরের কম সময়ে করোনাভাইরাসে বিশ্বজুড়ে প্রাণহানি ৫০ লাখ ছাড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশে সরকারি হিসাব অনুযায়ী হয়েছে এ বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু। যদিও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সব মৃত্যু নথিভুক্ত হয়নি বলে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।
রেফারেন্স ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যে করোনাভাইরাসে বৈশ্বিক মৃত্যু অর্ধকোটি ছাড়িয়েছে দুইদিন আগেই। তবে জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির হিসাবে চলমান মহামারিতে মৃতের সংখ্যা ৫০ লাখ পার হয়েছে সোমবার।
শুধু দরিদ্র দেশগুলোতেই মহামারির বিপর্যয় নেমে আসেনি, উন্নত দেশগুলোতেও স্বাস্থ্য খাতের ভগ্নদশা প্রকাশ্যে এনেছে করোনা।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার আট ভাগের মাত্র এক ভাগ রয়েছে উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত দেশগুলোতে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্র। করোনায় মোট প্রাণহানির অর্ধেকই হয়েছে এসব দেশে।
ভাইরাসটিতে শনাক্ত ও মৃত্যুর দিক থেকে শীর্ষস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে প্রাণ গেছে সাড়ে সাত লাখ মানুষের, সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা সাড়ে চার কোটির বেশি; যার ধারেকাছেও নেই আর কোনো দেশ।
ইয়েল স্কুল অফ পাবলিক হেলথের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যালবার্ট কো বলেন, ‘জীবদ্দশার অন্যতম উল্লেখযোগ্য সময় পার করছি আমরা। আরও ৫০ লাখ মানুষের মৃত্যু যেন না দেখতে হয়, সেজন্য নিজেদের সুরক্ষায় কী করণীয় আমাদের?’
জনস হপকিন্সের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে করোনায় মৃতের সংখ্যা লস অ্যাঞ্জেলেস ও স্যান ফ্রান্সিসকো শহরের মোট জনগোষ্ঠীর সমান।
অসলোর পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫০ সালের পর থেকে সাত দশকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ-বিগ্রহেও এত মানুষ নিহত হয়নি।
হৃদরোগ ও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পর বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর কারণ এখন ছোঁয়াচে করোনাভাইরাস।
অথচ করোনায় মৃতের প্রকৃত সংখ্যা যে ৫০ লাখের অনেক বেশি, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই গবেষকদের। কারণ হিসেবে বলা হয়- তৃতীয় বিশ্বে নমুনা পরীক্ষায় সীমাবদ্ধতা, সাধারণ সর্দিজ্বর ভেবে কিংবা হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা ধারণক্ষমতার বেশি বলে বাড়িতেই চিকিৎসা নেয়া ও গুরুতর ক্ষেত্রে মৃত্যু ইত্যাদি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ভারতের কথা। মহামারি করোনায় সংক্রমণ শনাক্তের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় ও মৃত্যুর দিক থেকে তৃতীয় শীর্ষ দেশ ভারত।
ভাইরাসটি প্রথম শনাক্তের পর থেকে ২২ মাসে মহামারির কেন্দ্র বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানান্তর হয়েছে। চীনের উহান শহর থেকে যুক্তরাজ্য-ইতালি-স্পেন-ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, এরপর যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, তারপর ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়া মহামারির কেন্দ্রে পরিণত হয়।
এক জায়গায় কমতে না কমতেই অন্যান্য অঞ্চলে সংক্রমণ বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় বর্তমানে মহামারির কেন্দ্র রাশিয়া, ইউক্রেন ও ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন অংশ।
মহামারির দেড় বছরের বেশি সময়ের মধ্যে অক্টোবর মাসে প্রথম করোনায় দিনে এক হাজারের বেশি মৃত্যু রেকর্ড করে রাশিয়া। এরপর প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে দেশটিতে।
গুজব, তথ্যের অপপ্রচার আর টিকা নিয়ে জনগণের মধ্যে অবিশ্বাসের জেরে বিপর্যস্ত বিভিন্ন দেশের সরকার। ইউক্রেনে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মাত্র ১৭ শতাংশ টিকার ডোজ সম্পন্ন করেছে, আর্মেনিয়ায় এ হার সাত শতাংশ।
কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির বৈশ্বিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র আইসিএপির পরিচালক ড. ওয়াফা আল-সদর বলেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক মহামারির একটি ব্যতিক্রমী দিক হলো, এটি ধনী দেশগুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে। করোনাভাইরাস বৈশ্বিক শ্রেণিবৈষম্যের প্রতি একটি বিদ্রুপ।’
তিনি জানান, ধনী দেশগুলোতে আয়ুষ্কাল দীর্ঘ। সেসব দেশে প্রবীণ, প্রাণঘাতী ক্যানসার থেকে সেরে ওঠা ও প্রবীন নিবাসে বসবাসরত মানুষের সংখ্যা বেশি। তাদেরই করোনায় মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
অন্যদিকে দরিদ্র দেশগুলোতে পরিবারে শিশু, কিশোর ও তরুণ সদস্যের সংখ্যা বেশি। তারা করোনায় আক্রান্ত হলেও গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি কম।