গত দেড় বছরে বিভিন্ন সময়ে হাইতি, তানজানিয়া, বুরুন্ডি, ইসোয়াতিনি ও আইভরি কোস্টের রাষ্ট্রনেতাদের মৃত্যুর কারণ করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা প্রত্যাখ্যান- এমন একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে।
একটি মিমে দাবি করা হয়েছে, টিকা না নেয়ায় এই পাঁচজন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানকে হত্যা করা হয়েছে।
বার্তা সংস্থা এএফপির ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনে বলা হয়, দাবিটি মিথ্যা।
গত ১৬ মাসের মধ্যে এই পাঁচ রাজনীতিবিদের মৃত্যু হয়েছে। কোনো কোনোটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, কোনোটি অসুস্থতাজনিত। কিন্তু কোনো মৃত্যুর সঙ্গেই টিকা প্রত্যাখ্যানের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
গত ২০ অক্টোবর ফেসবুকে তানজানিয়া থেকে মিমটি প্রথম পোস্ট করা হয়। পোস্টে যুক্ত ছবিটি কয়েকটি ছবির কোলাজ। ছবিতে আলাদা পাঁচটি প্যানেলের প্রতিটিতে রয়েছে আমেরিকান রম্য টিভি সিরিজ ‘দ্য অফিস’-এর চরিত্র জিম হ্যালপার্টের একটি করে ছবি। পাঁচটি প্যানেলে হ্যালপার্টের ছবির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে প্রয়াত পাঁচ রাষ্ট্রপ্রধানের আলাদা পাঁচটি ছবি।
প্রয়াত প্রত্যেকের ছবির নিচে তাদের নাম, দেশের নাম ও মৃত্যুকাল উল্লেখ করা হয়েছে।
মিমযুক্ত ফেসবুক পোস্টটির লিখিত অংশে বলা হয়েছে, ‘তারা সবাই কোভ্যাক্স কর্মসূচিকে না বলেছিলেন।’
বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে করোনা টিকার সুষম বণ্টন নিশ্চিতে জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গৃহীত কর্মসূচির নাম কোভ্যাক্স।
প্রকৃতপক্ষে এই নেতাদের মৃত্যুর সঙ্গে করোনা টিকার সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলেনি।
প্রেসিডেন্ট জোভেনেল মোউস, হাইতি
ক্যারিবীয় দেশ হাইতির প্রেসিডেন্ট নিজ বাসভবনে গুপ্তহত্যার শিকার হন চলতি বছরের ৭ জুলাই। রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সে গভীর রাতে ঢুকে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র ও কলম্বিয়ার নাগরিকদের সশস্ত্র একটি দল। হামলায় আহত হন তার স্ত্রী মার্টিন মোউসও।
মৃত্যুর আগে নিজ দেশবাসীর কাছেই মোউসের জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছিল। কিন্তু করোনা টিকাবিষয়ক সিদ্ধান্তের চেয়ে বেশি প্রেসিডেন্ট হিসেবে মোউসের মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের সম্পৃক্ততা বেশি বলে মনে করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
তাছাড়া মোউসে সরকার অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত টিকা নিয়ে দ্বিধায় থাকলেও করোনার টিকা প্রত্যাখ্যান করেনি।
কোভ্যাক্স কর্মসূচির আওতায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করোনা প্রতিরোধী টিকার পৌনে নয় লাখের বেশি ডোজ বরাদ্দ পেয়েছিল হাইতি। কিন্তু ভারতে টিকা উৎপাদন জটিলতায় সরবরাহও বিলম্বিত হয়। টিকা উৎপাদনে বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকা উৎপাদন করছে।
বিবৃতিতে হাইতির স্বাস্থ্যমন্ত্রী গ্রেটা রয় ক্লিমেন্ত জানান, টিকা ও রোগ প্রতিরোধবিষয়ক বৈশ্বিক জোট গ্যাভির কাছে চিঠি পাঠিয়ে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার পরিবর্তনে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের গবেষণালব্ধ করোনা টিকা পাঠানোর অনুরোধ করা হয়েছিল। অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাগ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রক্ত জমাট বাঁধার খবরে ওই অনুরোধ করা হয়। এর পরিবর্তে মডার্না, ফাইজার বা জ্যানসেন- যে প্রতিষ্ঠানের টিকাই সুলভ থাকবে, সেটাই পাঠানোর আহ্বান জানানো হয়।
জুনে হাইতি সরকার বেসরকারিভাবে টিকা আমদানির অনুমতি দেয় এবং পরের মাসেই দেশটিতে পাঁচ লাখ ডোজের প্রথম চালান পৌঁছায়।
জন মাগুফুলি, তানজানিয়া
পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জন মাগুফুলির মৃত্যু হয় চলতি বছরের ১৭ মার্চ। জীবদ্দশায় তিনি করোনাভাইরাস ও টিকা- দুটোই পশ্চিমা বিশ্বের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। ২০২০ সালের মে মাসে তার নির্দেশে করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করা বন্ধ হয়ে যায়।
সাত মাস আগে তার মৃত্যুর খবর প্রকাশ করেন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট সামিয়া সুলুহু হাসান। উত্তরসূরী সামিয়ার তথ্য অনুযায়ী, হৃৎপিণ্ডের জটিলতায় মৃত্যু হয়েছে মাগুফুলির। মৃত্যুর আগে দুই সপ্তাহের বেশি সময় জনসম্মুখে দেখা যায়নি প্রয়াত প্রেসিডেন্টকে।
কিন্তু ভাইরাল ফেসবুক পোস্টটিতে মাগুফুলিকে হত্যা করা হয়েছে বলে যে দাবি ছড়িয়েছে, তার সত্যতা নিশ্চিত করার মতো কোনো প্রমাণ মেলেনি।
অন্যদিকে বর্তমান প্রেসডেন্ট সামিয়া হাসান ক্ষমতা গ্রহণের পর করোনার বিস্তার রোধে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন। করোনা শনাক্তে নমুনা গ্রহণের কেন্দ্র খুলেছেন তিনি। জুন মাসে টিকাদান শুরু হবে বলে জানান। এপ্রিলে এক সাক্ষাৎকারে মহামারি উপেক্ষার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন।
হামেদ বাকায়োকো, আইভরি কোস্ট
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ আইভরি কোস্টের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামেদ বাকায়োকো গত মার্চে জার্মানিতে মৃত্যুবরণ করেন। ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন তিনি, জার্মানির একটি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল তার।
বাকায়োকো করোনার ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করেননি, টিকাও প্রত্যাখ্যান করেননি। ২০২০ সালের এপ্রিলে তিনি নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখন দেশবাসীর প্রতি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ করে বলেছিলেন, ‘করোনা সত্যিকারের একটি রোগ এবং খুব দ্রুত ছড়ায়।’
কোভ্যাক্সের আওতায় করোনার টিকার প্রথম চালান আইভরি কোস্টে পৌঁছায় গত ফেব্রুয়ারি মাসে।
অ্যামব্রোজ দ্লামিনি, ইসোয়াতিনি
আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত সাবেক সোয়াজিল্যান্ড, বা বর্তমান ইসোয়াতিনির প্রেসিডেন্ট ছিলেন অ্যামব্রোজ দ্লামিনি। করোনায় আক্রান্ত হয়ে চার সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই শেষে পরাজয় বরণ করেন ২০২০ সালের ডিসেম্বরে।
গত বছরের মার্চে করোনার কারণে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করে ইসোয়াতিনি এবং ধাপে ধাপে মহামারি রোধে নানা নীতি গ্রহণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনে লকডাউন, স্বাস্থ্যবিধি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাবিষয়ক বিধিনিষেধ জারি করে দেশটি।
দ্লামিনির মৃত্যুর আগে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে টিকা গ্রহণেও আগ্রহ দেখিয়েছিল দেশটি। পরে চলতি বছরের মার্চে ইসোয়াতিনিতে জাতীয় পর্যায়ে করোনার টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়।
পিয়েরে কুরুঞ্জিজা, বুরুন্ডি
পূর্ব আফ্রিকার দেশ বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট পিয়েরে কুরুঞ্জিজার হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মারা যান ২০২০ সালের ৮ জুন। করোনাভাইরাসের টিকা উদ্ভাবনের কয়েক মাস আগেই মৃত্যু হয় তার।
কুরুঞ্জিজার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বুরুন্ডিতে করোনার বিস্তার রোধে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কঠোর লকডাউনে যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনজীবন কার্যত অচল, তখনও জনসমাগমে কোনো বাধা ছিল না বুরুন্ডিতে।
কিন্তু কুরুঞ্জিজার মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরী ইভারিস্তে দায়িশিমিয়ে করোনাকে দেশের ‘সবচেয়ে বড় শত্রু’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু টিকাদানে ব্যবস্থা নেননি।