জীবন্ত পরজীবী দিয়ে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা তৈরি করা হয়েছে বলে সম্প্রতি বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে একটি গুঞ্জন ছড়িয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ায় ভাইরাল হয়েছে এ সংক্রান্ত পোস্ট।
চলতি মাসের ১৭ তারিখ ফেসবুকে প্রকাশিত কোরীয় ভাষার একটি পোস্টে বলা হয়, ‘এ টিকার প্রধান উপাদান গ্রাফেন। এই গ্রাফেনের ভেতরে জন্ম নেয় অ্যালুমিনিয়ামনির্ভর এক ধরনের পরজীবী।
‘মানবদেহে এই পরজীবী প্রবেশ করলে এর বিকাশ ও বংশবৃদ্ধি রোধের একটাই উপায়। সেটি হলো রক্ত পরিশোধন। সরকারের চাপে এমন একটি টিকা মানুষকে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
‘এই পরজীবী থেকে মুক্তি পেতে আইভারমেকটিন (পরজীবীবিরোধী ওষুধ) সেবন খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে নারীদের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে নিজেদের গর্ভ পরীক্ষা করানো উচিত।’
বার্তা সংস্থা এএফপির ফ্যাক্ট চেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দাবি সত্য নয়।
কথিত পরজীবীর একটি ছবিসহ এ দাবি ভাইরাল হয়েছে ফেসবুক, ইউটিউব ও অ্যান্ড্রয়েডভিত্তিক দাউম ক্যাফেতে। করোনা প্রতিরোধী টিকা নিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত একটি অনুষ্ঠান থেকে নেয়া হয়েছে ছবিটি।
স্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, টিকা তৈরির জন্য জীবাণুবিহীন পরিশুদ্ধ একটি পরিবেশ দরকার হয়। সেখানে উপাদান হিসেবে পরজীবী ব্যবহারের কোনো সুযোগই নেই।
কিউংপুক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মহামারি রোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কিম শিন-উ বলেন, ‘করোনার টিকায় কোনো পরজীবী থাকা সম্ভব নয়, উপাদান হিসেবে তো নয়ই। কারণ টিকা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দূষণ ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।’
দক্ষিণ কোরিয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থার মান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। ওষুধ উৎপাদনের সময় জীবাণুপ্রতিরোধী কঠোর ফার্মাসিউটিক্যাল বিধিমালা মেনে চলতে হয়।
অধ্যাপক শিন-উ বলেন, ‘এসব বিধি কার্যকর না হলে টিকা প্রয়োগে অনুমোদনই দেয়া হতো না।’
গাশন ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ মেডিসিন অ্যান্ড সায়েন্সের প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিষয়ের অধ্যাপক জুং জায়-হুন বলেন, ‘যে কোনো টিকা তৈরির ক্ষেত্রেই জীবাণুবিরোধী পরিবেশ রক্ষা বাধ্যতামূলক, যেখানে কোনো ক্ষতিকর জীবাণু বা ভাইরাসই প্রবেশ করতে বা টিকতে পারবে না। সেখানে পরজীবী থাকার তো প্রশ্নই নেই।’
দক্ষিণ কোরিয়ায় ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও জ্যানসেনের করোনা প্রতিরোধী টিকায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান উদ্ভাবিত টিকার উপাদানের তালিকায় কোনো পরজীবীর নাম নেই।
অনুমোদিত করোনা প্রতিরোধী টিকায় গ্রাফেন বা এর উপজাত গ্রাফেন অক্সাইডেরও উপস্থিতি নেই।
মানবদেহে কোনো পরজীবীর উপস্থিতি নিশ্চিত না হলে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া আইভারমেকটিন ওষুধ ব্যবহারের বিষয়েও সতর্ক করেছেন স্বাস্থ্যবিদরা।
অধ্যাপক জুং বলেন, ‘আইভারমেকটিনের মতো ওষুধ সেবনে শরীরকে ক্লান্ত করে ফেলে। করোনাভাইরাসের টিকা নেয়ার পর এ ওষুধ সেবন করে কোনো লাভ হবে না কারণ টিকার সঙ্গে পরজীবীর কোনো সম্পর্ক নেই।’
করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসায় আইভারমেকটিন ব্যবহারের বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এফডিএ। করোনা ঠেকাতে এ ওষুধ কার্যকর বলে পরীক্ষায় প্রমাণ মেলেনি বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
এ ছাড়া নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি আইভারমেকটিন প্রয়োগের শঙ্কা থেকে যায়, যার ফলে বমি, বমিভাব, ডায়রিয়া, নিম্ন রক্তচাপ, ক্লান্তি, চুলকানি ও চর্মরোগের মতো অ্যালার্জিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, শরীরের ভারসাম্যহীনতা, খিঁচুনি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। কোমায় চলে যাওয়া, এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও রয়েছে।
পরীক্ষামূলকভাবে ছাড়া করোনার চিকিৎসায় আইভারমেকটিন ব্যবহার না করার পরামর্শ দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও।