দেবী দুর্গার প্রতিমায় উঠে এলো রাষ্ট্রহীন মানুষের প্রতিচ্ছবি। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবে ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব ইস্যুকে তুলে ধরলেন সুশীলরা।
এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় একটি পূজা মণ্ডপে এ বছর ‘ভাগের মা’ সাজানো হয়েছে দুর্গাকে। এর মাধ্যমে উৎসবের আমেজে তুলে ধরা হয়েছে সমাজে বিভক্তি আর অভিবাসী সংকটে জর্জরিত মানুষের মুখকে।
‘ভাগের মা’ থিমে পূজা মণ্ডপ সাজিয়েছে দক্ষিণ কলকাতার বারিশা ক্লাব। নরেন্দ্র মোদির সরকারের জাতীয় নাগরিকত্ব তালিকাকে (এনআরসি) কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বিতর্ক এবং ভারতের সমাজে অভিবাসী বংশোদ্ভূতদের দুর্দশা প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্যান্ডেলগুলোতে।
গত বছরের পূজাতেও অভিবাসী বংশোদ্ভূতদের নিয়ে প্যান্ডেল সাজিয়ে শহরজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল ক্লাবটি। এ বছর মণ্ডপ দুই ভাগে বিভক্ত করে সাজানো হয়েছে। বাম পাশের অংশ বাংলাদেশ এবং ডান পাশের অংশ ভারতীয় সীমান্তের প্রতীক।
দুটোর মাঝখানে ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’, যেখানে দেবী দুর্গাকে বহন করা এক নারীর প্রতিমা রয়েছে। নারীটিকে ঘিরে রয়েছে তার চার সন্তান, যারা ডিটেনশন কেন্দ্রে আটক শরণার্থী পরিবারের সদস্য।
একটি ট্রাকের ভেতরে বসে থাকা ওই নারীর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে তার সংসারের জিনিসপত্র। এলোমেলো জিনিসপত্রের মধ্যে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে একটি রঙিন শাড়ি আর পুরো দৃশ্যের পেছনে ছাদ থেকে ঝুলছে কয়েকটি ভোটার পরিচয়পত্রের কার্ড, যার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মানুষের নাগরিকত্ব হারানোর ভীতি।
পূজা মণ্ডপের স্থপতি রিন্টু দাস টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়াকে বলেন, ‘নাগরিকত্ব হারানো এক ধরনের অস্তিত্বের সংকট। দেশভাগ আর মানুষের জীবনে এর যন্ত্রণা বাংলা আজও ভুলতে পারেনি। মানুষ আরও একবার সবকিছু হারানোর শঙ্কায় ভীত-সন্ত্রস্ত। এই সময়ে আরেকবার সেই ক্ষতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আমি।
চূড়ান্ত নাগরিকত্ব তালিকা বা এনআরসির মাধ্যমে ভারতের বৈধ নাগরিকদের শনাক্ত ও স্বীকৃতির কথা বলছে দেশটির সরকার। আসাম রাজ্যে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে এ তালিকায় ঠাঁই হয়নি ১৯ লাখের বেশি বাসিন্দার। ২০১৯ সালে তালিকাভুক্তির আবেদন করা রাজ্যের সাড়ে তিন কোটি বাসিন্দার অন্তর্ভুক্ত তারা। বিষয়টি নিয়ে সে সময় ভারতের রাজনীতিতে তুমুল জলঘোলা হয়।
কাছাকাছি সময় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হয়। দুটি বিষয় মিলিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়, যা পরে গণআন্দোলনে রূপ নিলেও করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়।
গত বছর বারিশা ক্লাবের দুর্গা পূজার মণ্ডপে দেবী প্রতিমাটি ছিল এক অভিবাসী মায়ের। করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আরোপিত লকডাউনের সময় আশ্রয়ের খোঁজে শত শত কিলোমিটার হাঁটা ভাসমান শ্রমিকের রূপে দুর্গাকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন রিন্টু দাস।
তিনি বলেছিলেন, ‘প্রখর সূর্যের তাপ, ক্ষুধা আর দারিদ্রকে উপেক্ষা করে সন্তানদের নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন দেবী… সন্তানদের নিয়ে মায়েদের অদম্য সে যাত্রা আমার অনুভূতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আমার মনে দেবী দুর্গাকে ধারণ করেছিলেন তারাই।’
চলতি বছর প্রতিমাটি তৈরি করেছেন দেবায়ন প্রামাণিক, প্রতাপ মজুমদার ও সুমিত বিশ্বাস। বিশাল মণ্ডপের পুরোটাতেই এক রঙের প্রাধান্য রেখে এক ধরনের বিষণ্নতার পরিবেশ ফুটিয়ে তুলেছেন তারা।
রিন্টু দাস বলেন, ‘মা কি ডিটেনশন ক্যাম্পে যাচ্ছেন? এমন অগণিত পরিবারের ভবিষ্যৎ কী? যারাই এ মণ্ডপে আসবেন, সেই দর্শনার্থীদের কাছেই এ প্রশ্নের উত্তর ছেড়ে দিয়েছি আমি।’
কলকাতার দুর্গা পূজার মণ্ডপে সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়াবলী ফুটিয়ে তোলা প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা। উত্তর কলকাতায় বিশাল একটি পূজা মণ্ডপের থিম গড়ে তোলা হয়েছে বিতর্কিত কৃষি আইনের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ভারতীয় কৃষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে।