কয়েক দিন আগে এক সন্ধ্যায় কাবুলের গুজারগাহ এলাকায় একটি সেতুর নিচে আলো-আঁধারির মাঝে গিয়ে হাজির হন গুটিকয়েক তালেবান সেনা। তাদের হাতে চাবুক আর কাঁধে ঝুলছিল রাইফেল।
এ সময় সেতুর নিচে ময়লা আবর্জনা আর দুর্গন্ধ থেকে কয়েকজনকে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন সেনাদের একজন। নির্দেশ পেয়ে হতবিহ্বল কয়েকজন বেরিয়েও এলেন। বাকিদের জোর করে বাইরে আনা হলো।
আগন্তুক সেনাটি এবার নির্দেশ দিলেন, মাদক সেবনের জন্য যার কাছে যা আছে সব হস্তান্তর করার জন্য। এই নির্দেশের পর নোংরা বেশভূষার মানুষগুলোর কয়েকজন হাতে থাকা অবশিষ্ট হেরোইনটুকু তাড়াহুড়ো করে সেবনের উদ্যোগ নিলেন।
দলটির মধ্যে এক ব্যক্তি তড়িঘড়ি করে একটি লাইটার জ্বালিয়ে মুখের সামনে একটি ফয়েল পেপারের নিচে ধরলেন। একটি পাইপ মুখে দিয়ে তিনি হেরোইনের ধোঁয়াটুকু টেনে নিচ্ছিলেন।
আরেকজন অবশ্য কিছুটা প্রতিবাদের সুরে বলে উঠলেন, ‘এগুলো ভিটামিন!’
তালেবান সেনা কারি ফেদায়ি তখন অন্য এক মাদকাসক্তের হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধছিলেন।
ফেদায়ি বলেন, ‘এরা এ দেশেরই লোক। এদের মাঝে অনেক ভালো মানুষও আছে। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় এদের এখন চিকিৎসার জন্য পাঠানো হবে।’
রক্তচক্ষু আর কঙ্কালসার মানুষগুলোর মধ্যে বয়স্ক এক ব্যক্তি নিজেকে কবি দাবি করে বসলেন। বললেন, এবারের মত ছেড়ে দিলে তিনি আর কখনোই মাদক সেবন করবেন না। একটা কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে কবিতার লাইন পড়ে তিনি নিজেকে কবি প্রমাণ করার চেষ্টাও করলেন। কিন্তু এতে কোনো কাজ হলো না।
কাবুলের গুজারগাহ এলাকায় এই সেতুর নিচে মাদকসেবীদের আস্তানা
ফরাসি বার্তা সংস্থা এপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী তালেবান এবার দেশের মাদকাসক্তি নির্মূলে মন দিয়েছে। জোর করে হলেও তারা মাদকাসক্ত আফগানদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চায়।
তাই প্রায় প্রতি রাতেই কিছু তালেবান যোদ্ধা পুলিশের বেশে অবতীর্ণ হচ্ছেন এবং মাদকাসক্তদের আস্তানায় হানা দিচ্ছেন। মাদকাসক্তদের আটক করে তারা কতগুলো পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছেন। সোজা কথায় কাজ না হলে কোনো কোনো মাদকাসক্তকে বেদম মারধরও করছেন তারা।
বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ, আগ্রাসন আর ক্ষুধা-দারিদ্র্যের হতাশা থেকে আফগানিস্তানের বিপুল সংখ্যক মানুষ মাদকাসক্তিতে ভোগছেন। তাদের মাঝে যেমন আছেন কবি, তেমনি আছেন- সাবেক সেনা, ব্যবসায়ী এমনকি কৃষকও।
বিশ্বজুড়ে যে পরিমাণ হেরোইন পাওয়া যায় তার একটি বড় অংশই আসে আফগানিস্তানের পপি চাষ থেকে। তাই দেশটিতে এই মাদক খুবই সহজলভ্য।
মাদকাসক্তদের মধ্যে কে ছোট, কে বড়, কে ধনী আর কে গরিব তার কোনো বাছ-বিচার নেই তালেবানদের কাছে। তাদের প্রস্তাবিত শারিয়া আইনেও মাদকের কোনো ঠাঁই নেই।
তবে মাদকের বিরুদ্ধে তালেবানের যুদ্ধ প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। কারণ হেরোইনের কাঁচামাল আফিম কিংবা পপি চাষে তাদেরও ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। আফিমের উৎপাদন দেশটির অর্থনীতি ও অস্থিরতার সঙ্গেও নিবিড়ভাবে জড়িত। দেশটিতে যেসব কৃষক আফিম কিংবা পপি চাষ করেন, তাদের ভূমিকা অনেকটা তালেবানের গ্রাম পুলিশের মতো।
গত দুই দশক ধরে বিদেশি সেনা নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে তালেবানরা মাদক চোরাচালান ও পপি চাষীদের ওপর কর আরোপ করেই বিপুল অর্থ আয় করেছে। যদিও তারা এ ধরনের অভিযোগ বরাবরই নাকচ করে এসেছে। মাদকের বিরুদ্ধে অতীতে তাদের অবস্থান নিয়েও উচ্চ-বাচ্য করে তারা।
আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা অবস্থানের আগে ২০০০-০১ সালে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দেশে আফিম উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছিল তালেবান। কিন্তু পরে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়ে টিকে থাকার জন্য এর ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়েছে তাদের।
আবিসিনা মেডিক্যাল হাসপাতালে নেয়ার পর মাথা কামানো হচ্ছে এক মাদকাসক্তের
সেদিনের সেই সন্ধ্যায় গুজারগাহর সেই সেতুর নিচ থেকে অন্তত দেড়শ মাদকাসক্তকে আটক করেছিল তালেবানরা। পরে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় কাবুলে অবস্থিত মাদকাসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্র আবিসিনা মেডিক্যাল হাসপাতালে। ২০০৩ সালে মার্কিন সেনারা এই ভবনটি নির্মাণ করেছিল। এখানেই ছিল তাদের আলোচিত ক্যাম্প ‘ফনিস্ক’। পরে ২০১৬ সালে মার্কিন সেনারাই এটিকে মাদক চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে এখানে একসঙ্গে ১ হাজার মাদকাসক্তের চিকিৎসা করা সম্ভব।
আবিসিনা মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে যাওয়ার পর সেদিন প্রথমেই সব মাদকাসক্তের মাথা কামানো হয়। পরে গোসল করিয়ে রোগী হিসেবে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
হাসপাতালটিতে বর্তমানে ৭০০ মাদকাসক্ত রয়েছেন। তাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন পরিবারের সদস্যরা যার খোঁজ জানেনা দীর্ঘদিন।
এমনই এক মাদকাসক্তের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তার মা সিতারা। ফরাসি সংবাদ সংস্থা এপি’র একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়- ২১ বছর বয়সী মাদকাসক্ত ছেলেকে ফিরে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সিতারা। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে তিনি বলছিলেন, ‘আমার জীবনে আমার ছেলেই সব।’
পুনর্বাসন কেন্দ্রে মাদকাসক্ত ছেলের সামনে সিতারা