ইয়েমেনের কথিত ‘নরকের কুয়া’। স্থানীয়দের বিশ্বাস- এটি একটি কারাগার, যেখানে জিনদের আটকে রাখা হয় বা হতো। ‘নিষিদ্ধ’ কুয়ার গভীরে গেলে জীবন অভিশপ্ত হয়ে যাবে বলেও মনে করেন অনেকে।
যদিও এসব ধারণার কোনো ভিত্তি নেই, তাও ভয়েই কখনো সাড়ে তিন শ ফুটের বেশি গভীর কুয়াটিতে নামার চেষ্টা করেননি কুসংস্কারাচ্ছন্ন স্থানীয় ইয়েমেনিরা। অদ্ভুত এক গন্ধ ভেসে আসে গুহা থেকে।
শেষ পর্যন্ত গুজব আমলে না নিয়ে প্রথমবারের মতো কুয়াটির রহস্য উন্মোচনে এর তলদেশে পৌঁছেছেন ওমানের একদল বিশেষজ্ঞ।
বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে ফ্রান্স টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ইয়েমেনের পূর্বাঞ্চলীয় আল-মাহরা প্রদেশের মরু অঞ্চলে অবস্থিত অন্ধকার গুহাটি প্রকৃতির এক অনন্য বিস্ময়। কয়েকটি হিসাব অনুযায়ী এটি চওড়ায় ১০০ ফুট; সমতল থেকে তলদেশ পর্যন্ত এর উচ্চতা ৩৬৭ ফুট।
ওমানের গুহা পর্যবেক্ষক দল ওসিইটি কুয়াটির ভেতরে সাপ, প্রাণির দেহাবশেষ আর ‘কেইভ পার্ল’ বা চুনাপাথরের মুক্তা খুঁজে পেয়েছেন। জিন বা অতিপ্রাকৃত কিছুর চিহ্ন খুঁজে পাননি তারা।
কথিত নরকের কুয়ার প্রবেশপথ। ছবি: এএফপি
ওমানের জার্মান ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির ভূতত্ত্বের অধ্যাপক মোহাম্মদ আল-কিন্দি বলেন, ‘অনেক সাপ ছিল। কেউ বিরক্ত না করলেও সেগুলোও কারও দিকে তাকিয়ে দেখে না।’
গত সপ্তাহে গুহাটিতে নামেন আটজন অভিজ্ঞ অভিযাত্রী। ওসিইটি দলের বাকি দুই সহকর্মী অবস্থান নেন গুহার বাইরে। গুহায় নামার সময়ের এবং তলদেশ থেকে ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজে কুয়ার দেয়ালের গঠন, ধূসর আর হালকা সবুজ পাথুরে মুক্তা দেখা যায়। ওপর থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়া পানির কারণে তৈরি হয়েছে মুক্তাগুলো।
একটি খনিজ ও তেলবিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী কিন্দি বলেন, ‘রোমাঞ্চের অনুভূতি পেতেই কুয়াটির প্রতি আগ্রহী হয়েছিলাম আমরা। মনে হয়েছিল একটা নতুন রহস্যে আলো ফেলতে পারব আমরা, উন্মোচন করতে পারব ইয়েমেনের ইতিহাসের একটি অংশ।
‘আমরা কুয়াটির পানি, পাথর, মাটি ও কিছু মৃত জীবের নমুনা সংগ্রহ করেছি। সেগুলো বিশ্লেষণের পর দ্রুতই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।’
কুয়ার ভেতরের অদ্ভুত গন্ধের উৎস সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কিছু মরা পাখি পড়েছিল। সেগুলো থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায় বটে, কিন্তু তা অসহনীয় কিছু নয়।’
ইয়েমেনের বিস্তীর্ণ মরু অঞ্চলে অবস্থিত গুহাটিকে 'দুর্ভাগ্যের প্রতীক' মনে করেন স্থানীয়রা। ছবি: এএফপি
চলতি বছরের জুনেই ইয়েমেনের সরকারি কর্মকর্তারা এএফপিকে জানিয়েছিলেন, গুহার তলদেশে কী আছে না আছে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা নেই তাদের। কখনোই গুহার তলদেশে তারা পৌঁছাননি। গুহাটির বয়স কয়েক কোটি বছর বলে ধারণার কথাও জানান তারা।
মাহরাহ অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক জরিপ ও খনিজ সম্পদবিষয়ক কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক সালাহ বাভাইর সে সময় বলেছিলেন, ‘গুহার ওই এলাকা পরিদর্শন করেছি আমরা। গুহায় প্রবেশও করেছিলাম। কিন্তু ৫০-৬০ মিটারের বেশি গভীরে যেতে পারিনি।
‘ভিতরে অদ্ভুত কিছু লক্ষ্য করেছিলাম। অপরিচিত গন্ধ ভেসে আসছিল… রহস্যময় একটা পরিবেশ ছিল।’
কয়েক শ বছর ধরে কুয়াটিকে ঘিরে ছড়িয়েছে নানা কল্পকাহিনি। বিভিন্ন ভৌতিক বা কাল্পনিক চরিত্রকে ঘিরে তৈরি এসব গল্পে কুয়ার বাসিন্দা মূলত জিন, যাদের পার করে যেতে হয় নরকে। অর্থাৎ নরকের প্রবেশপথও মনে করা হয় কুয়াটিকে।
স্থানীয় বাসিন্দারা একে দুর্ভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করেন। অনেকে এলাকাটিতে পা ফেলতেও অস্বস্তিবোধ করেন, কেউ কেউ এ নিয়ে কথা বলতেও ভয় পান।
তারা মনে করেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন যথেষ্ট দুর্ভাগ্যের শিকার, নতুন করে কোনো অভিশাপের প্রয়োজন নেই তাদের।
২০১৪ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে ইয়েমেনে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানবিক সংকট পীড়িত দেশটির জনসংখ্যা তিন কোটি, যাদের এক-তৃতীয়াংশই বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করে বাঁচছেন।