১০ মাস পর নতুন গতি পেল ভারতের কৃষক আন্দোলন। বিতর্কিত তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে সোমবার ভোর থেকে শুরু হয় ‘ভারত বনধ্’ কর্মসূচি। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার হাজারো কৃষকের অবস্থান ধর্মঘটে অচল রাজধানী দিল্লির সীমান্ত। বাতিল হয়েছে বেশ কয়েকটি ট্রেন।
পার্লামেন্টে আইন তিনটি অনুমোদন পাওয়ার এক বছর পূর্ণ হওয়ার দিনে ‘ভারত বনধ’ বা দেশজুড়ে ধর্মঘটের ডাক দেয় সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা (এসকেএম)। ৪০টি কৃষক ইউনিয়নের জোট এসকেএমের ডাকে বেশ কয়েকটি জাতীয় মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেন আন্দোলনরত কৃষকরা।
এসকেএম জানায়, কর্মসূচির আওতায় বন্ধ থাকবে সারা ভারতের স্কুল, কলেজ, সরকারি, বেসরকারি অফিস-আদালত ও অন্যান্য কর্মক্ষেত্র, দোকানপাট, কলকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু। কেবল জরুরি সেবা চালু রাখতে দেয়া হবে বলে জানায় জোটটি।
এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় সময় ভোর ছয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত হয় এ বিক্ষোভ। গাজিপুরের আন্দোলনস্থলের কাছে দিল্লি-মিরাট এক্সপ্রেসওয়ে বন্ধ করে দেন বিক্ষুব্ধ কৃষকরা। এতে উত্তর প্রদেশ থেকে বের হওয়া যানবাহন মাঝপথেই আটকা পড়ে। গুরগাওঁ ও নয়ডার সঙ্গে দিল্লি সীমান্তে তৈরি হয় বিশাল যানজট।
রাজধানীতে প্রবেশের পথে সব যানবাহনে দিল্লি পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা তল্লাশি করায় যানজট আরও দীর্ঘ হয়। বন্ধ ছিল পাঞ্জাব ও হরিয়ানার শম্ভু সীমান্তও।
প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসসহ অনেকগুলো রাজনৈতিক দল ও বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকারও কৃষকদের এ আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছে।
কংগ্রেস দলটির প্রত্যেক কর্মী, রাজ্য শাখার প্রধান ও অন্যান্য নেতাদের ভারত বনধ্-এ যোগ দেয়ার আহ্বান জানায়।
পাঞ্জাব কংগ্রেসের প্রধান নভজ্যোৎ সিং সিধু দলীয় কর্মীদের বিক্ষোভরত কৃষকদের সঙ্গে থাকার আহ্বান জানান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে তিনি লেখেন, ‘ন্যায় ও অন্যায়ের লড়াইয়ে নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ নেই। তিনটি অসাংবিধানিক কালো আইনের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে লড়াই করতে কংগ্রেসের প্রতিটি কর্মীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি আমরা।’
উত্তর প্রদেশের বহুজন সমাজ পার্টির প্রধান মায়াবতী জানান, শান্তিপূর্ণ ভারত বনধ্ কর্মসূচিতে তার দলেরও সমর্থন আছে।
তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে গত বছরের নভেম্বর থেকে চলছে এ কৃষক আন্দোলন। টানা ১০ মাস বাড়ি ফেরেননি বিক্ষোভরত লাখো কৃষক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘতম সময় ধরে চলা বিক্ষোভ এটি।
যাবতীয় প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে নিজেদের দাবি আদায়ে অনড় কৃষকরা। তীব্র শীত, দাবদাহ, ঝড়-বৃষ্টি, এমনকি করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও রাজধানী নয়া দিল্লিসংলগ্ন প্রধান মহাসড়কগুলোতে তাঁবু খাটিয়ে থাকছেন তারা।
ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের (বিকেইউ) প্রধান রাকেশ তিকাইত রোববার বলেন, ‘প্রয়োজনে আরও ১০ বছর বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত কৃষকরা। তাও কলঙ্কজনক এ আইন বাতিল হবে না।
‘কৃষিমন্ত্রী আমাদের আলোচনার জন্য ডাকছেন। আলোচনায় বসতে আমাদের সমস্যা নেই। খালি সময় আর জায়গা বললেই হবে। কিন্তু তিনি বলছেন যে এসব আইন নাকি আমাদেরই স্বার্থে। তাহলে ১০ বছর লাগলেও এ জায়গা থেকে নড়ছি না আমরা।’
গত বছরের সেপ্টেম্বরে পার্লামেন্টে পাস হয় তিনটি কৃষি আইন। কৃষকদের দাবি, এসব আইনের ফলে বস্তুত কৃষি খাতের বেসরকারিকরণ ঘটবে এবং খাতটি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে। কারণ আইনগুলোতে সরকার নিয়ন্ত্রিত পাইকারি বাজারের চেয়েও কম দামে পণ্য কেনার সুযোগ দেয়া হয়েছে ক্রেতাদের। এতে উৎপাদক পর্যায়ে ন্যূনতম দামও মিলবে না বলে শঙ্কা কৃষকদের।
ক্ষুদ্র চাষিদের মতে, বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে দৌড়ে পিছিয়ে পড়বেন তারা। এতে গম ও চালের মতো প্রধান শস্যগুলো অনেক কম দামে বিক্রি করতে হবে তাদের।
যদিও মোদি সরকারের দাবি, কৃষি আইন সংস্কারের ফলে কৃষকদের জন্য নতুন সুযোগ ও ভালো দাম পাওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে।
এসকেএম জোটের অভিমন্যু কোহারের বরাত দিয়ে আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০ মাস ধরে মোদি সরকার কৃষকদের দাবি ও বিক্ষোভ উপেক্ষা করছে। তাই বাধ্য হয়েই সরকারের নীতিমালার বিরুদ্ধে সব অঞ্চল, শ্রেণির, বয়সের কৃষক ও কৃষিপণ্যের বাণিজ্যে সংশ্লিষ্টদের ভারত বনধ্ কর্মসূচিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাতে হয়েছে।
কোহার বলেন, ‘সরকার দাবি করছে যে, বিরোধী দলশাসিত দুই থেকে তিনটি রাজ্যেই নাকি বিক্ষোভ হচ্ছে। কিন্তু আজ আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন যে সারা দেশের মানুষের সমর্থন রয়েছে আমাদের প্রতি। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, আসাম থেকে গুজরাট পর্যন্ত ছড়িয়েছে এ আন্দোলন।’
হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ আর কর্ণাটকসহ মোদির দল বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোর কৃষকরাও আন্দোলনে যোগ দিয়েছে বলে জানান কোহার।
চলতি মাসের শুরুতে ভারতের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্য উত্তর প্রদেশে একটি সমাবেশে যোগ দেয় পাঁচ লাখের বেশি কৃষক। চলমান কৃষক আন্দোলনে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় কর্মসূচি সেটি।
সব কর্মসূচিই শান্তিপূর্ণ থাকবে বলে আগেই আশ্বাস দিয়েছে কৃষক ইউনিয়নগুলো। এ পর্যন্ত বেশিরভাগ আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হলেও চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি ট্রাক্টর মিছিলের সময় সংঘর্ষে প্রাণ যায় কমপক্ষে একজনের; আহত হয় ৮০ জনের বেশি পুলিশ সদস্য।
প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন ওই সহিংসতার জন্য কৃষকদের দায়ী করেছিল মোদি প্রশাসন। কৃষকদের দাবি ছিল, অনুপ্রবেশকারীদের দিয়ে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করে কৃষকদের ন্যায্য আন্দোলন বন্ধের অপচেষ্টা ছিল সেটি।
১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতের অর্ধেক বাসিন্দাই জীবিকা অর্জনের জন্য কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। দেশটির দুই দশমিক সাত ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির প্রায় ১৫ শতাংশই কৃষিনির্ভর।