দ্বিতীয় দফায় আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ফাটল তীব্র হচ্ছে শাসক দল তালেবানের মধ্যে। দূরত্ব বাড়ছে কট্টরপন্থি ও তুলনামূলক উদার নেতাদের মধ্যে।
তালেবান নেতাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত দুই আফগান সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, শুরুতে লড়াই পর্দার আড়ালেই চলছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে বিভক্তির সত্যতা প্রকট হয়ে ওঠে উপ-প্রধানমন্ত্রী আব্দুল গনি বারাদারের মৃত্যুর গুজব ছড়ালে।
প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে তালেবানের দুই পক্ষের তুমুল ঝগড়া-বিবাদের পর উপ-প্রধানমন্ত্রী আব্দুল গনি বারাদার সহিংসতায় নিহত হয়েছেন বলে গুজব ছড়ায় সে সময়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই দুই আফগান বলেন, গুজব এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে শেষ পর্যন্ত বারাদার বেঁচে আছেন প্রমাণে একটি অডিও ও একটি হাতে লেখা বিবৃতি প্রকাশ করে তালেবান। অডিও ও লিখিত বিবৃতিতে বারাদার জানিয়েছেন যে তিনি বেঁচে আছেন, যদিও এসবের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো।
সবশেষ বুধবার আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলে বারাদারের একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারেও তাকে বলতে শোনা যায় যে তিনি বেঁচে আছেন। নিজের মৃত্যুর গুজব নিয়ে তিনি বলেন, ‘কাবুল থেকে অন্য অঞ্চলে সফর করছিলাম আমি। সেখানে বসে এসব গুজব প্রত্যাখ্যানের জন্য আধুনিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সুযোগ ছিল না।’
যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে সক্ষম প্রথম তালেবান নেতা বারাদার। ২০২০ সালে সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপ হয় তালেবান সহ-প্রতিষ্ঠাতার।
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার ইস্যুতে আলোচনা ও চুক্তিতে তালেবানের প্রধান প্রতিনিধি ছিলেন বারাদার। চুক্তি অনুযায়ী সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হয় গত মাসে। এর দুই সপ্তাহ আগেই রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান।
তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর সম্ভাব্য সরকারপ্রধান হিসেবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিলেন বারাদার। তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠন করবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু সব প্রত্যাশা ধুলোয় মিশে যায় যখন পুরুষসর্বস্ব এবং কেবল তালেবানের প্রতিষ্ঠিত নেতাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়; বাদ দেয়া হয় আদিবাসী নেতা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রতিনিধিদের।
আফগানিস্তানকে ‘ইসলামি আমিরাত’ ঘোষণা করে ৭ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিসভার তালিকা প্রকাশ করা হয়। মন্ত্রিসভার শীর্ষ পদে বেশির ভাগ নেতা কট্টরপন্থি। তারা সম্প্রতি মুখে সব পক্ষের অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের আশ্বাস দিলেও কাজে নব্বইয়ের দশকের কঠোর শাসনের পুনরাবৃত্তি করছেন বলেও অভিযোগ মধ্যপন্থিদের।
বারাদারের বদলে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পান তালেবানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ। তিনি জাতিসংঘের কালো তালিকাভুক্ত। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যখন তালেবান আফগানিস্তান শাসন করেছে, সে সময় দেশটির উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন হাসান আখুন্দ।
এ ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজুদ্দিন হাক্কানি নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো এফবিআইয়ের ‘ওয়ান্টেড’ তালিকাভুক্ত। তাকে ধরিয়ে দিলে এক কোটি ডলার পুরস্কার দেবে এফবিআই।
কট্টরপন্থি শাসনের পরবর্তী লক্ষণ হিসেবে প্রেসিডেন্ট প্যালেস থেকে নামিয়ে ফেলা হয় আফগানিস্তানের জাতীয় পতাকা, বসানো হয় তালেবানের নিজস্ব পতাকা।
যদিও পতাকার বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তালেবান কর্মকর্তা। দুটি পতাকা পাশাপাশি রাখা হতে পারে বলেও জানান তিনি।
তালেবানের অন্তর্কোন্দলের বিষয়ে অবগত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই আফগান জানান, এসব ইস্যুতে মন্ত্রিসভার কোনো এক সদস্য মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন কট্টরপন্থি বাকি মন্ত্রীরা।
তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ নেতৃত্বে ফাটলের খবর প্রত্যাখ্যান করেছেন। মঙ্গলবার এসব খবরকে ‘অপপ্রচার’ বলে দাবি করেন তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুতাকি।
কিন্তু এত সব প্রচেষ্টাতেও গুজবের অবসান ঘটছে না। কারণ গত কয়েক দিনে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে সরকারের উপপ্রধান হিসেবে বারাদারের অনুপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
এমনকি গত রোববার কাবুল সফররত কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুলরহমান আল-থানির সঙ্গে তালেবান সরকারের বৈঠকেও ছিলেন না উপপ্রধানমন্ত্রী। ২০ বছর পর তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর এটি ছিল সবচেয়ে শীর্ষ কোনো পররাষ্ট্রীয় প্রতিনিধির আফগানিস্তান সফর। তার ওপর কাতারের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের দীর্ঘ আলোচনায় বারাদার ছিলেন দোহার নিয়মিত অতিথি।
ওই বৈঠকে না থাকার বিষয়ে বুধবারের ভিডিওতে বারাদার জানিয়েছেন, কাবুলে কাতারি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের বিষয়ে আগে থেকে কিছু জানতেন না তিনি। ফলে আগেই কাবুল ছেড়েছিলেন সফরের উদ্দেশ্যে এবং পরে কাতারি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আগমনের বিষয়ে জানতে পারলেও ঠিক সময়ে কাবুলে ফিরতে পারেননি।
বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত আফগান আর বারাদারের সঙ্গে যোগাযোগে থাকা ব্যক্তিরা এপিকে জানিয়েছেন, তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুনজাদার সঙ্গে বৈঠকের জন্য দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ কান্দাহারে ছিলেন বারাদার।
অন্যদিকে আরেক তালেবান নেতা জানান, আফগানিস্তানের ২০ বছরের যুদ্ধে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা হয়নি বারাদারের। ক্লান্ত বারাদার তাই পরিবারের কাছে ফিরেছিলেন কিছু সময়ের জন্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তালেবানের মধ্যে ফাটল এলেও এখনই ভাঙনের পর্যায়ে চলে যাওয়ার মতো গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের এশিয়াবিষয়ক প্রকল্পের উপপরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘হাজার বিতর্ক সত্ত্বেও বছরের পর বছর তালেবানকে সব সময় একজোট দেখেছে বহির্বিশ্ব। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাদের ঐক্যের কোনো নড়চড় হয় না। আমি মনে করি, বর্তমান অভ্যন্তরীণ মতবিরোধও সহজেই মিটিয়ে ফেলবে তারা।
‘তবে ক্ষমতায় টিকে থাকা নিয়ে, বৈধতা অর্জন নিয়ে এবং বড় ধরনের নীতিগত পরিবর্তন নিয়ে তালেবান যে চাপে আছে, তা সহজে মেটার নয়। এসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে সাংগঠনিক দিক থেকে আরও বেশি চাপের মুখে পড়বে তারা; এ ধরনের গুরুতর অভ্যন্তরীণ ঝগড়া-বিবাদও বাড়তে থাকবে।’
তবে তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মোল্লা ওমরের মতো বলিষ্ঠ নেতা ছাড়া দলটিতে চলমান দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানো সন্দেহাতীতভাবেই কঠিন।
কোনো রকম প্রশ্ন ছাড়াই মোল্লা ওমরে আস্থা রাখতেন তালেবানের প্রত্যেক সদস্য। বর্তমান নেতা হায়বাতুল্লাহ আখুনজাদাও মোল্লা ওমরের মতোই লোকচক্ষুর আড়ালের জীবন বেছে নিলেও দলের এ সংকটে তিনি কীভাবে হাল ধরেন, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।