ভূমিকম্পের মতোই তালেবানের আফগানিস্তান দখলের প্রভাব আশপাশের অঞ্চলগুলোতে অনেক বছর থেকে যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা মনে করছেন, মধ্যপ্রাচ্যে আর্থ-সামাজিক ও ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে তালেবানশাসিত আফগানিস্তান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, কট্টরপন্থি তালেবান সাংগঠনিক আধুনিকায়নের কথা বললেও কার্যত তারা আগের মতোই আছে। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা নেয়ার প্রথম মাসের তালেবান সরকার আর ২০ বছর আগে প্রথম ক্ষমতায় থাকা তালেবান সরকারের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না।
ওই কর্মকর্তার মতে, আফগানিস্তান থেকে তাড়াহুড়ো করে বিশৃঙ্খলভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোকে বেশ কিছু প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। পরবর্তী ২০ বছরে নিরাপত্তা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া প্রতিশ্রুতির বিশ্বাসযোগ্যতাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্পের মতো আমাদের ওপর ভেঙে পড়েছে আফগানিস্তান। এই সংকট অনেক, অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী হবে…পরের ২০ বছর কি আমরা আসলেই যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিরাপত্তার ছায়ার ওপর নির্ভর করতে পারব? আমার মনে হয় যে, পরিস্থিতি এখন সত্যিই জটিল, ভীষণ জটিল।’
তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের পারস্য উপসাগরবিষয়ক নীতিমালা কার্টার ডকট্রিনের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক ছিল আফগানিস্তান অধ্যায়।
১৯৮০ সালে এ নীতিটি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনে সামরিক শক্তি প্রয়োগের কথা বলা হয়েছিল নীতিটিতে। মূলত বিদেশি তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত নীতিটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা মনে করেন, আফগানিস্তানে দুই দশকের ‘যুদ্ধটি ছিল মূলত তাদের বিরুদ্ধে, যারা ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল।’ অথচ বিদেশি ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম এই যুদ্ধে লাখো মানুষের প্রাণ গেলেও শেষ পর্যন্ত লড়াই শেষ হয়েছে কার্যকর কোনো সমাধান ছাড়াই।
তার অনুমান, তালেবানের হঠাৎ আফগানিস্তান দখল পশ্চিম আফ্রিকা ও সাহেল অঞ্চলের নেতাদের মধ্যেও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, তালেবানের শাসন অঞ্চলটিতে ইসলামপন্থি উগ্রবাদীদের নতুন করে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে পারে।
নব্বইয়ের দশকের তুলনায় একবিংশ শতাব্দীর তালেবানের আচরণে ভিন্নতার আশা রাখাও বোকামি বলে উল্লেখ করেন ওই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ‘এ কথা ঠিক যে, এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আগের তুলনায় আরও বেশি সংযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে গোষ্ঠীটি। কিন্তু তাদের মূলে কোনো পরিবর্তন আসেনি।’
তার মতে, আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিকে সম্ভবত পাকিস্তানের জন্য জয় আর চীনের জন্য নতুন সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ন্যূনতম।
তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানকে নিয়ে ভূরাজনৈতিক লড়াই হলে একদিকে থাকবে পাকিস্তান ও চীন, অন্যদিকে থাকবে ভারত, ইরান আর রাশিয়া। এখানে যুক্তরাষ্ট্র আর কখনো কেন্দ্রীয় শক্তিতে উঠে আসতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।’
পারস্য উপসাগরীয় অনেক দেশ এরই মধ্যে নিজেদের পররাষ্ট্র নীতিমালা ঢেলে সাজাতে শুরু করেছে। সম্ভাব্য নতুন নীতিমালায় তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতার মতো বিষয়গুলোকে বাদ দেয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের ওই কর্মকর্তার মতে, ভবিষ্যতে ইরানের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে দেখা যেতে পারে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও।
সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর কার্বন পরবর্তী যুগের লক্ষণ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ওই কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্বের ফলে নিরাপত্তায় যেন হুমকি তৈরি না হয়, তা নিশ্চিতে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো নিজেদের উৎসে বৈচিত্র্য আনতে চায়।
ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির আমলেই সৌদি আরবের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তবে সে উদ্যোগ কেবল গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানে সহযোগিতার মধ্যেই সীমিত ছিল। ভবিষ্যতে তেহরান-রিয়াদের আলোচনার পরিসর আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
পারস্য অঞ্চলে নতুন মিত্রের খোঁজে গত এক বছরে তৎপর হয়েছে বিভিন্ন দেশ। ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করেছে বাহরাইনসহ বেশ কয়েকটি দেশ। সিরিয়ার সঙ্গে আরব আমিরাতও কূটনৈতিক সম্পর্কে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
দীর্ঘ যুদ্ধের চাপে ‘প্রেশার কুকারে’ থাকা মধ্যপ্রাচ্যকে শান্ত করতে এসব পদক্ষেপ কাজে আসবে বলে আশাবাদী বিশ্লেষকরা।