একসময় যে তালেবান সদস্যদের বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি দিয়েছিলেন, আজ তাদের হাত থেকেই বাঁচতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আফগানিস্তানের নারী বিচারকরা। হন্যে হয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন তারা।
কাবুল বিমানবন্দর হয়ে পশ্চিমাদের সহযোগিতায় ইউরোপে পৌঁছেছেন সাবেক এক আফগান নারী বিচারক। দেশ ছেড়ে পালানোর কারণ হিসেবে তিনি জানান, দেশ দখলের পর তাকে খুঁজছিল তালেবান যোদ্ধারা। এই যোদ্ধাদের একসময় কারাদণ্ড দিয়েছিলেন তিনি। ক্ষমতা নিয়েই তাদের মুক্ত করে দিয়েছে শাসকদল।
অজ্ঞাতপরিচয় অবস্থান থেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বিচারক বলেন, ‘চার-পাঁচজন তালেবান সদস্য বাড়িতে এসে আমার খোঁজ করেছিল। জানতে চাইছিল যে নারী বিচারকটা কোথায়। এই লোকগুলোকে একসময় আমি জেলে পাঠিয়েছিলাম।’
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়, আফগানিস্তানে নারী বিচারকের সংখ্যা প্রায় আড়াই শ। এদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন সম্প্রতি দেশ ছাড়তে পেরেছেন। বাকিরা আফগানিস্তানেই রয়ে গেছেন এবং প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়ার পথ খুঁজছেন।
তাদের আফগানিস্তান থেকে বের করতে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করছেন অন্য দেশের একই পেশাজীবী ও অধিকারকর্মীরা। এ লক্ষ্যে কয়েকটি নেটওয়ার্কও তৈরি করেছেন তারা।
গত কয়েক সপ্তাহে দেশের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলো দখলের পর ১৫ আগস্ট রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। ২০ বছর পর ক্ষমতায় এসে আবারও বেশির ভাগ পেশায় কর্মরত নারীদের কর্মস্থলে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আফগানিস্তানের নতুন শাসকগোষ্ঠী।
ক্ষমতা দখলের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে শরিয়াহ আইন অনুযায়ী নারীদের অধিকার রক্ষার কথা বলেছিলেন তালেবান মুখপাত্র। তিনি জানিয়েছিলেন, দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে নারীদের কাজ করারও অনুমতি দেবে নতুন সরকার।
বিদেশি সহায়তানির্ভর আফগানিস্তানের অর্থনীতি সচল রাখতে বিশ্বসম্প্রদায়ের স্বীকৃতি পেতে চায় তালেবান। তাদের সঙ্গে কাজ করার জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোও। কিন্তু শর্ত বেঁধে দিয়েছে এই বলে যে, নারী ও মানবাধিকার নিশ্চিত কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করতে হবে তালেবানকে।
আফগানিস্তানের বিচার বিভাগে কর্মরত নারীরা আগেও বিভিন্ন সময় হামলার শিকার হয়েছেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতেই দেশটির সর্বোচ্চ আদালতের দুই নারী বিচারপতিকে গুলি করে হত্যা করে অজ্ঞাতপরিচয় দুর্বৃত্তরা। সে সময় ওই হত্যাকাণ্ডে তালেবান জড়িত নয় বলে দাবি করেছিলেন সংগঠনটির মুখপাত্র।
এখন ক্ষমতায় এসেই সারা দেশের বন্দিদের মুক্ত করে দেয়ায় আফগান নারী বিচারকদের জীবনের নিরাপত্তা আরও বড় ঝুঁকিতে পড়ল বলে মনে করছেন ইউরোপে অবস্থানরত ওই বিচারক।
দেশে থাকা নিজ সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন ওই বিচারক।
তিনি বলেন, ‘তাদের পাঠানো বার্তাগুলো ভয়ে, আতঙ্কে ভরা। তারা আমাকে জানিয়েছে, দ্রুত উদ্ধার করা না গেলে হয়তো মৃত্যুই তাদের শেষ পরিণতি।’
নারী বিচারকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন আইএডব্লিউজের সহযোগিতায় দেশ ছেড়ে পালাতে পেরেছেন এই বিচারক।
বিচারক ছাড়াও মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করা হাজারো নারী এখন তালেবানের চক্ষুশূল বলে জানিয়েছেন আফগান মানবাধিকারকর্মী হুরিয়া মুসাদিক।
তিনি বলেন, “মুক্তি পাওয়া বন্দিরা নারী বিচারক, নারী কৌঁসুলি ও নারী পুলিশ কর্মকর্তাদের সমানে হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। ‘আমরা তোমাদের খোঁজে আসছি’ বলে বার্তাও দিচ্ছে তারা।”
গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের আইনমন্ত্রী রবার্ট বাকল্যান্ড জানান, ৯ আফগান নারী বিচারককে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। ঝুঁকিতে থাকা অন্যদেরও নিরাপদে আফগানিস্তান থেকে বের করার চেষ্টা চলছে।
নারী বিচারক ও মানবাধিকারকর্মীদের উদ্ধারে চেষ্টারত আইনজীবী ও সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নিজ নাগরিকদের উদ্ধারেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো।
বেলফাস্টভিত্তিক মানবাধিকার আইনজীবী ও আইনজীবীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন অ্যাটলাস উইমেনের সদস্য সারাহ কে বলেন, ‘কাবুলের পতনের পর বিমানবন্দরে গোলযোগের মধ্যে কোনো দেশই নিজ নাগরিক বাদে অন্য নাগরিকদের উদ্ধারে এতটুকু আগ্রহ দেখায়নি।’