আফগানিস্তানের মসনদে দ্বিতীয়বারের মতো বসতে যাচ্ছে তালেবান। তালেবানের এবারের শাসন আগের মতোই হবে নাকি ভিন্ন হবে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে পাকিস্তান ও কাতারের ওপর।
কারণ আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারে দেশ দুটি সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছে। আফগানিস্তানে প্রভাব বজায় রাখা পাকিস্তানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব খাটানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয় কাতার।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনা আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের পর পশ্চিমাসহ বিভিন্ন দেশের আচরণ আফগানিস্তানের প্রতি কেমন হয়, তাও বিবেচ্য বিষয়।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশি সরকার, সহায়তা সংস্থা, দাতাগোষ্ঠী ও বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি বেশির ভাগ আফগান কাবুলকে ঘিরে কাতার ও পাকিস্তানের প্রতিযোগিতায় কাতারকেই বেছে নেবে।
পাকিস্তানের অভিভাবকত্বে আগের শাসনে তালেবান প্রশাসনের কর্মকাণ্ডে এবার অনেকেই আশাবাদী হতে পারছে না।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে কাতারের ভূমিকা সরাসরি কেউ প্রত্যক্ষ করেনি। কাতারের অভিভাবকত্ব পাকিস্তানের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আফগানিস্তানের ওপর প্রভাব বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাতার ও পাকিস্তানের মধ্যে কে জিতবে, তা তালেবানের অভ্যন্তরে আরেকটি প্রতিযোগিতার ওপর নির্ভরশীল।
হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা হলেও সংগঠনটিতে তার আধিপত্য একচেটিয়া নয়।
তালেবানের সহপ্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আব্দুল গনি বারাদরের নেতৃত্বাধীন সংগঠনটির রাজনৈতিক উপদলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে কাতারের।
অন্যদিকে তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের ছেলে মোল্লা ইয়াকুব, হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান সিরাজুদ্দিন হাক্কানির নেতৃত্বাধীন তালেবানের সামরিক শাখাকে সমর্থন দিচ্ছে পাকিস্তান।
বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে, এবারের পরিস্থিতি কাতারের জন্য অনুকূল। গত তিন বছর কাতারের রাজধানী দোহায় ছিলেন বারাদর। ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের পর দেশে ফেরেন তিনি।
আফগানিস্তানে নতুন সরকারের প্রধান হিসেবে বারাদরের নাম বারবার উঠে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন মনে করছে, বারাদরের সঙ্গে তারা ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে।
গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর প্রধান উইলিয়াম বার্নসের সঙ্গে বারাদরের গোপন বৈঠকও হয়।
সাম্প্রতিক এসব ঘটনা পাকিস্তানকে চিন্তায় ফেলেছে। বারাদরের সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই দেশটির।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযানে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পাকিস্তান বারাদরকে শুরুতে আশ্রয় দিলেও পরে ২০১০ সালে গ্রেপ্তার করে।
পাকিস্তানে কারাগারে থাকাকালে বারাদরকে নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
অন্যদিকে আফগানিস্তানের আগামী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে কাতারের কাছ থেকে বরাবরই খাতির পেয়ে আসছেন বারাদর।
অবশ্য তালেবান সরকারের প্রধান বারাদর হলেও তালেবানের মূল ক্ষমতা আখুন্দজাদার শুরার (কাউন্সিল) মধ্যেই নিহিত।
তালেবানের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের শাসনামলে কাবুলে গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রায়ই কান্দাহারে তালেবানের শুরা সদস্যরা প্রত্যাখ্যান করেন।
২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তালেবান যোদ্ধাদের সংঘবদ্ধ করার পাশাপাশি অস্ত্র-সহায়তা দেয় পাকিস্তান।
অন্যদিকে দোহায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি অন্যান্য শক্তির সঙ্গে তালেবানের শান্তিচুক্তি সম্পাদনে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে কাতার।
তালেবান তার সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাইলে পাকিস্তানের চেয়ে কাতারের সমর্থনকারী দেশগুলো অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা নেবে।
আর তালেবান যদি অর্থ বা বিনিয়োগ চায়, তাহলে সেসব দেয়ার ক্ষমতা কাতারের অঢেল, যা পাকিস্তানের নেই।
দেশ চালাতে অর্থ বা বিনিয়োগের জোগান তালেবানের নতুন প্রশাসনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে কাবুল পতনের পর পশ্চিমা দেশ ও সংস্থা এরই মধ্যে আফগানিস্তানে অর্থসহায়তা আটকে দিয়েছে।
অন্যদিকে পাকিস্তানি ও আফগানদের মধ্যে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বন্ধন অনেক শক্তিশালী, যা কাতারের সঙ্গে আফগানিস্তানের নেই।
আফগানিস্তানে বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার গঠন কাতারের জন্য স্বস্তির। অন্যদিকে আফগানিস্তানকে পাশে পাওয়া পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য।
কারণ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী মনে করে, ভারতের সঙ্গে শত্রুতায় আফগানিস্তান কৌশলগত সহায়তা করে আসছে।
তাই আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারে কাতারের চেয়ে পাকিস্তান আপ্রাণ চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক।