অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করলেও তালেবান অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
তার মতে, ২০ বছর আগের তুলনায় গোষ্ঠীটির খুব একটা আদর্শগত পরিবর্তন না ঘটলেও বিশ্ব সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি পেতে মরিয়া তারা। অস্তিত্বসংকটের কেন্দ্রে এ বিষয়টিই।
এবিসি নিউজের গুড মর্নিং আমেরিকা অনুষ্ঠানে স্থানীয় সময় বুধবার এসব কথা বলেন বাইডেন। এবিসি নিউজের অনলাইন সংস্করণে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হয় বৃহস্পতিবার।
সাক্ষাৎকারে তালেবানশাসিত সরকার আন্তর্জাতিক বৈধতা পাবে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন বলেও জানান বাইডেন।
তিনি বলেন, ‘তালেবান নিজেদের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠায় অগ্রাধিকার দিতে চায়। কিন্তু তাদের খাবার খেয়ে বাঁচতে হবে। সে জন্য আয় করতে হবে, অর্থনীতি সচল রাখতে হবে। চাইলেও সামাজিক ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করতে পারবে না তারা।’
চলতি বছরের মে মাসে আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের দখল নিতে আগ্রাসী অভিযান শুরু করে তালেবান। বিষয়টির পরিপ্রেক্ষিতে সে সময় দেশটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গোষ্ঠীটির হাতে চলে যাবে বলে বিশ্লেষকরা সতর্ক করলেও সে শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছিলেন বাইডেন।
উপস্থাপক জর্জ স্টেফানোপওলাস ও জো বাইডেন। ছবি: এবিসি নিউজ
এ বিষয়ে সাংবাদিক জর্জ স্টেফানোপওলাসের প্রশ্নের উত্তরে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বলেন, গত ২০ বছরে তিন লাখ আফগান সেনাকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা এত সহজে হাল ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করবে বলে ভাবেননি তিনি।
পূর্ণাঙ্গ সেনা প্রত্যাহারের ফলে তালেবানশাসিত আফগানিস্তান আল-কায়েদা ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর চারণক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে কি না, বৈশ্বিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে কি না, এমন প্রশ্নেরও উত্তর দেন বাইডেন।
তার মতে, আফগানিস্তানের চেয়ে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে আল-কায়েদার মতো নিষিদ্ধঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কারণে সৃষ্ট ঝুঁকির মাত্রা বেশি। সেনা প্রত্যাহার সিদ্ধান্তের সাফাই গেয়ে তিনি বলেন, ‘ঝুঁকি যেখানে বেশি, সেসব জায়গায় নজর দিতে হবে আমাদের, যেমন সিরিয়া বা পূর্ব আফ্রিকা।’
বিদেশি সেনা প্রত্যাহারের সুযোগে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ১০ দিনে কাবুল ও ২২টি প্রাদেশিক রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান। রাজধানীসহ দেশের প্রধান শহর কান্দাহার, হেরাত, জালালাবাদ, মাজার-ই-শরিফ দখলে কোনো রকম বাধার মুখে পড়তে হয়নি গোষ্ঠীটিকে। অথচ তালেবানবিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল শহরগুলো।
পূর্ণাঙ্গ সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাতিলে বাইডেন সরকারকে সতর্ক করেছিলেন বলে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সামরিক উপদেষ্টারা জানালেও তা প্রত্যাখ্যান করেন প্রেসিডেন্ট।
পূর্বসূরি ডনাল্ড ট্রাম্প তালেবানের সঙ্গে চুক্তি না করলে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর নিজেই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন বলে জানান বাইডেন।
বিদেশি ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম, দুই দশকের যুদ্ধে ইতি টানার কোনো সঠিক সময় কখনোই আসত না বলে মন্তব্য করেন বাইডেন।
সেনা প্রত্যাহার সিদ্ধান্তের সাফাই গেয়ে তিনি বলেন, ‘গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে আমাদের ব্যয় এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। তাও এ যুদ্ধ জয়ের কোনো সম্ভাবনা আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি।’
৩১ আগস্টের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে পূর্ণাঙ্গ সেনা প্রত্যাহারের কথা থাকলেও তারিখটি পেছাতে পারে বলে আভাস দেন বাইডেন।
তিনি বলেন, ‘আফগান ভূখণ্ডে একজন নাগরিককেও ফেলে আসবে না যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাত হাজার নাগরিককে কাবুল থেকে সরাতে পারলে ৩১ আগস্টের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ সেনা প্রত্যাহার সম্ভব। তা না হলে আরও কিছুদিন সেখানে থাকতে হতে পারে সেনাদের, তবে তা কোনোমতেই চাই না আমরা।’
১৫ আগস্ট থেকে পাঁচ দিনে কাবুল বিমানবন্দর হয়ে ১৮ হাজার মানুষ আফগানিস্তান ছেড়েছেন বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটো। এদের মধ্যে আমেরিকান নাগরিক ও যুক্তরাষ্ট্রের বৈধ স্থায়ী বাসিন্দা এক হাজার ৭৯২ জন। গতকাল পর্যন্ত ছয় হাজার ৭৪১ জনকে ফিরিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
চলতি মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী আফগানদের সরিয়ে নেয়া সম্ভব কি না জানতে চাইলে বাইডেন জানান, তাদের বিষয়ে নিশ্চিত নন তিনি।
পরিস্থিতির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পরিবারের সদস্যসহ মিত্র আফগানদের সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার। নিরাপত্তা নিশ্চিতে তাদের আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পুনর্বাসনের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। প্রতিশ্রুতি পূরণের চেষ্টাও চলছে।’
তবে আফগান নাগরিক বা অন্য কারও জন্য নয়, ৩১ আগস্টের পরও যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের আফগানিস্তানে থাকতে হলে কেবল আমেরিকান নাগরিকদের জন্যই থাকবে বলে জানিয়েছেন বাইডেন।
এতে আফগানদের দেয়া প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন হচ্ছে কি না জানতে চাইলে বাইডেন বলেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
কাবুল বিমানবন্দরে অবস্থানরত আমেরিকান কূটনীতিক ও তাদের আফগান সহযোগীদের ওপর কোনো হামলা বা হুমকি কিংবা তাদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন না ঘটাতে সোমবার তালেবানকে সতর্ক করেন বাইডেন।
হোয়াইট হাউস থেকে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনো হামলা হলে তাৎক্ষণিক সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে উপযুক্ত জবাব দেবে যুক্তরাষ্ট্র।’
নারীদের প্রতি তালেবানের আচরণ নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে শঙ্কা ঘনিয়ে উঠছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বাইডেন বলেন, ‘সারা পৃথিবীতে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে নারী অধিকার রক্ষা করা বাস্তব বুদ্ধি নয়।
‘কূটনৈতিকভাবে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। কাজ না হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের আচরণ বদলাতে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।’
কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর গত সোমবার আফগানিস্তানে ‘যুদ্ধ শেষ’ বলে ঘোষণা দেয় তালেবান।