এখন পর্যন্ত তালেবানের আয়ের প্রধান উৎস আফিম ও হেরোইন। খনিজে সমৃদ্ধ আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে দেশের সব সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ এখন সশস্ত্র গোষ্ঠীটির হাতে। সীমান্তের ওপারে নিকটতম পরাশক্তিধর প্রতিবেশী চীনেরও নজর আছে এতে।
বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর কাছে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচিত তালেবান। ২০ বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক কারণে তালেবানশাসিত আফগানিস্তানকে একঘরে করার উপায় নেই দেশগুলোর।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ আফগানিস্তানের ভূগর্ভে ২০১০ সালে সঞ্চিত ছিল এক ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের খনিজ সম্পদ। লোহা, তামা, লিথিয়াম, কোবাল্ট ও বিরল আকরিকের বিপুল ভান্ডার রয়েছে দেশটিতে।
জার্মানিভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, অব্যাহত সংঘাত-সহিংসতার কারণে গত এক দশকেও এসব সম্পদে মানুষের স্পর্শ খুব একটা লাগেনি। অনুত্তোলিতই থেকে গেছে প্রায় পুরোটা। আর এই সময়ে এসব খনিজ সম্পদের বাজারমূল্য আকাশ ছুঁয়েছে।
২০১৭ সালে তৎকালীন আফগান সরকারের পুনর্মূল্যায়নে জানা যায়, জীবাশ্ম জ্বালানিসহ কাবুলের নিয়ন্ত্রণে থাকা খনিজ সম্পদের মূল্যমান প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলার।
বিদ্যুৎচালিত গাড়ি, স্মার্টফোন ও ল্যাপটপের ব্যাটারিতে ব্যবহৃত লিথিয়ামের চাহিদা গত কয়েক বছর ধরে আকাশচুম্বী। কয়েক বছর আগেও এর বার্ষিক চাহিদা ছিল পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ, যা বর্তমানে ২০ শতাংশ।
এনএসএনার্জি বিজনেসের গত বছরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৯ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভূগর্ভে আট কোটি টন লিথিয়ামের নিশ্চিত মজুত বলে শনাক্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের তুলনায় এক বছরে শনাক্তকৃত লিথিয়ামের মজুত বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
বিশ্বে লিথিয়ামের সবচেয়ে বড় মজুত এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়ায়। দেশটিতে লিথিয়ামের মজুত রয়েছে দুই কোটি ১০ লাখ টন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের একটি নথিতে বলা হয়, আফগানিস্তানেও লিথিয়ামের সম্ভাব্য মজুত বলিভিয়ার সমপরিমাণ।
করোনাভাইরাস মহামারি চলমান থাকা অবস্থায় যখন বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে, তখন বেড়েছে তামার চাহিদাও। এক বছর আগের তুলনায় তামার চাহিদা বেড়েছে ৪৩ শতাংশ।
চীন-রাশিয়া ও পাকিস্তানের নজর
তালেবানকে আফগানিস্তানের সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব। বিপরীতে তালেবানের সরকার গঠনের আগেই ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছে চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তান।
তবে এ দৌড়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে এগিয়ে চীন।
সারা বিশ্বের শিল্পপণ্যের প্রায় অর্ধেকই উৎপাদন করে চীন। লক্ষ্য- নিত্যপণ্যের বৈশ্বিক চাহিদা পূরণে শীর্ষে থাকা। কয়েক দশকের রাজনৈতিক অস্থিরতার কেন্দ্র দরিদ্র আফগানিস্তানেও এসব চাহিদা তৈরি ও পূরণে দেশটির অবকাঠামো পুনর্গঠনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে বেইজিং।
এরই মধ্যে আফগানিস্তানে বিদেশি বিনিয়োগের শীর্ষে পৌঁছেছে চীনা সরকার। ধারণা করা হচ্ছে, চীনে শিল্পপণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের চাহিদা মেটাতে আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের ওপর নজর রয়েছে বেইজিংয়ের। এ জন্য আফগান ভূখণ্ডে খনিজবিষয়ক অবকাঠামো ও কার্যকরী খনন ব্যবস্থা গড়ে তুলতেও সহযোগিতা করতে চায় চীনা সরকার।
অস্ট্রিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপিয়ান অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসির জ্যেষ্ঠ ফেলো মিখাইল তানশুম বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী এসব খনিজ সম্পদের সংকটের সময়েই আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এসেছে তালেবান। সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য অমূল্য এসব সম্পদ দরকার চীনের। আফগানিস্তান থেকে এসব খনিজ সম্পদ সংগ্রহে এরই মধ্যে দেশটিতে নিজেদের অবস্থানও তৈরি করেছে দেশটি।’
এশিয়ায় খনিজ সম্পদ উত্তোলনে অন্যতম প্রতিষ্ঠান চীনের মেটালার্জিক্যাল করপোরেশন অফ চায়না (এমসিসি)। এরই মধ্যে আফগানিস্তানের অনুর্বর লোগার প্রদেশে তামা উত্তোলনের দায়িত্ব নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ৩০ বছরের জন্য ইজারা নিয়েছে খনি অঞ্চল।
তবে মাদক উৎপাদন ও বিক্রি করে যে পরিমাণ আয় করে তালেবান, সে অর্থের পরিমাণও বেশ বড় অঙ্কের। এ অবস্থায় দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার তালেবান নষ্ট করতে চাইবে কি না, সে বিষয়ে সন্দিহান অনেক বিশ্লেষক। প্রশ্ন আছে তালেবানের সক্ষমতা নিয়েও।
কাউন্টার এক্সট্রিমিজম প্রজেক্টের জ্যেষ্ঠ পরিচালক হ্যান্স-জ্যাকব শিন্ডলার বলেন, ‘নব্বইয়ের দশকেও এসব সম্পদ আফগানিস্তানে ছিল। কিন্তু তখন এগুলো উত্তোলন করতে পারেনি তালেবান। আফগানিস্তানের অর্থনীতি সম্প্রসারণ করতে কিংবা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারেও তাদের সক্ষমতা কতটুকু, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।’
এমন পরিস্থিতিতেই সম্প্রতি বেইজিংয়ের আমন্ত্রণে চীনের তিয়ানজিন সফর করে তালেবানের একটি প্রতিনিধিদল। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে বৈঠক করেন খোদ তালেবানের পরবর্তী সম্ভাব্য নেতা ও বর্তমান রাজনৈতিক শাখার প্রধান মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার।
সে সময় বারাদার বলেন, ‘আফগানিস্তান পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে আগের চেয়েও বড় ভূমিকায় থাকবে চীন।’
এশিয়া ও ইউরোপকে সড়ক, রেল ও সমুদ্রপথে যুক্ত করতে যে বিতর্কিত ও উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হাতে নিয়েছে চীন, সেই ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড কর্মসূচি’র মাধ্যমেও লাভবান হওয়ার কথা আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ সরকারের।