বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কোণঠাসা তালেবান যেভাবে আবার অপ্রতিরোধ্য

  •    
  • ১৫ আগস্ট, ২০২১ ১৬:০৪

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপে তালেবানের নব্বইয়ের দশকের শাসনামল স্থায়ী হয়েছিল ছয় বছর। যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জোটের সেনাদের অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় দফায় তালেবানের ভবিষ্যৎ শাসন কতটা দীর্ঘ হবে, তা নিয়ে শঙ্কিত বিশ্ব।

১০ দিন পেরোনোর আগেই আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রাদেশিক রাজধানীর ২২টি দখল করে নিয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবান। কান্দাহার, হেরাত, মাজার-ই-শরিফ, জালালাবাদসহ দেশের সবগুলো বড় শহর নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর রাজধানী কাবুল ঘিরে ফেলেছে গোষ্ঠীটি।

আফগান সরকারের আত্মসমর্পণের অপেক্ষায় এখনই কাবুলে প্রবেশ না করলেও পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন রাজধানী।

দুই দশকের সামরিক অবস্থানে ইতি টানতে যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটো চলতি বছরের মে মাসে আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহার শুরু করে। এরপর মাত্র তিন মাসে সংঘাতপ্রবণ দেশটিতে নতুন করে বিপুল শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে তালেবান। নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল।

তিন লাখ আফগান সেনার বিপরীতে তালেবানের সদস্য সংখ্যা মাত্র ৮৫ হাজার। তা সত্ত্বেও দীর্ঘ ২০ বছর পর অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বিজয় অর্জন করেছে গোষ্ঠীটি। দেশজুড়ে কট্টরপন্থি ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক গোষ্ঠীটির রয়েছে অগনতি সমর্থক ও সহযোগী।

তালেবান প্রতিষ্ঠার পটভূমি

আরবি ভাষায় ‘তালেবান’ শব্দটির অর্থ হলো জ্ঞান অর্জনকারী বা শিক্ষার্থী।

তালেবান সদস্যদের বেশিরভাগই শিক্ষা গ্রহণ করেছেন আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের আফগান সীমান্ত এলাকার রক্ষণশীল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।

সাবেক সোভিয়েত আমলে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় বছরের লড়াই করে আফগান স্বাধীনতাকামীরা। ‘মুজাহিদিন’ হিসেবে পরিচিত স্বাধীনতাকামীদের একটি অংশ ছিল তালেবানও।

মূলত ১৯৭৮ সালে এক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে আফগানিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়া থেকে এ লড়াইয়ের শুরু। ওই অভ্যুত্থান ঘটাতে সমাজতান্ত্রিক নেতাদের মদদ দিয়েছিল তখনকার সোভিয়েত সরকার।

এরপরই ১৯৭৯ সাল থেকে সোভিয়েত উপনিবেশের বিরুদ্ধ সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে মুজাহিদিনরা। আশির দশকজুড়ে এ বিপ্লবে মুজাহিদিনদের অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

সোভিয়েতবিরোধী নীতির আওতায় ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী মুজাহিদিনদের সহযোগিতার দায়িত্ব নিয়েছিল ওয়াশিংটন। কারণ সে সময় স্নায়ুযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ ছিল তখনকার সোভিয়েত সরকার বা ‘ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস’, সংক্ষেপে ইউএসএসআর, অর্থাৎ বর্তমান রাশিয়া।

তুমুল গোলমেলে পরিস্থিতির মধ্যে ১৯৮৯ সালে আফগান ভূখণ্ড ছাড়ে সোভিয়েত সেনারা।

নেতৃত্ব সংকটে সে সময় চরম অস্থিতিশীলতার মুখে পড়ে আফগানিস্তান। ১৯৯২ সালে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লড়াইয়ে জড়ায় খোদ মুজাহিদিন কমান্ডাররাই। সম্পর্ক ছিন্ন করে আলাদা হয় তালেবান।

এতে বিভক্ত হয় কাবুল। প্রতিদিন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কয়েক শ রকেট এসে পড়ত রাজধানী নগরীটিতে।

তালেবানের উত্থানের শুরু যেভাবে

নব্বইয়ের দশকের এ গৃহযুদ্ধের মধ্যেই মূলত ১৯৯৪ সালে শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তালেবান। আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বড় শহর পশতু অধ্যুষিত কান্দাহার দখল থেকে শুরু হয় উত্থান।

সে সময় ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় তালেবানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মুজাহিদিন কমান্ডার ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়।

১৯৯৬ সালে প্রথমবার রাজধানী কাবুল দখল করে তালেবান। কাবুল স্কয়ারে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলায় আফগানিস্তানের শেষ বামপন্থি প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহ আহমাদজাইকে।

এরপরই আফগানিস্তানকে ‘ইসলামি আমিরাত’ ঘোষণা করে তালেবান। শুরু হয় তালেবানের নিজস্ব ব্যাখ্যায় দাঁড় করানো কট্টর শরিয়াহ আইনের বাস্তবায়ন।

শুরুর দিকে কিছুটা স্বীকৃতি পেয়েছিল তালেবান

বেশ সহজেই অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল তৎকালীন তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকার।

কারণ আপাতদৃষ্টিতে স্থিতিশীল আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিল গোষ্ঠীটি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শুরুর দিকে ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল তালেবান।

জনসাধারণকে আশ্বাস দেয় নিরাপদ নাগরিক জীবনের। বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধে অতিষ্ঠ আফগান জনতাও স্বাভাবিকভাবেই নতুন জীবনের আশায় স্বাগত জানায় তালেবান যোদ্ধাদের। এভাবে একে একে আফগানিস্তানের সব শহরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

পরে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও পাকিস্তানসহ মোট তিনটি দেশ আফগানিস্তানের শাসক দল হিসেবে তালেবানকে স্বীকৃতি দেয়।

ছয় বছরের কঠোর শাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন

শুরুর দিকে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের যুক্তি হিসেবে গৃহযুদ্ধকালীন অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর কথা বলেছিল তালেবান। কিন্তু পরে সেসব বিধিনিষেধ আর প্রত্যাহার করেনি।

এসব বিধিনিষেধের মধ্যে ছিল নারীদের শিক্ষাগ্রহণ ও চিকিৎসা বাদে অন্য সব ধরনের পেশায় তাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করার মতো বিষয়গুলো।

ধর্মীয় রীতির নামে নিষিদ্ধ ছিল গান শোনা, টেলিভিশন দেখাসহ বিনোদন ও অবসর সময় কাটানোর নির্দোষ নানা মাধ্যমের ব্যবহার।

খেলাধুলাও নিয়ন্ত্রণ করা হতো কঠোরভাবে। শুধু পুরুষরাই খেলাধুলায় অংশ নিতে পারত, কিন্তু তাদের রক্ষণশীল পোশাক পরে খেলতে হতো এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় বিরতি বাধ্যতামূলক ছিল।

তালেবানের শাসনামলে এসব কঠোর বিধিনিষেধ কেউ না মানলে তাকে প্রকাশ্যে পেটানো হতো বা কারাদণ্ড দেয়া হতো।

ছয় বছরের শাসনজুড়ে আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরও চরম নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে।

২০০১ সালে বামিয়ান প্রদেশে গৌতম বুদ্ধের ঐতিহাসিক ভাস্কর্য ধ্বংসে তালেবানের সিদ্ধান্ত সমালোচিত হয়েছিল বিশ্বজুড়ে।

তালেবানের বিরুদ্ধে তৎপর বিশ্ব সম্প্রদায়

সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ১৯৯৯ সালে তালেবানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় জাতিসংঘ।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারসহ যুক্তরাষ্ট্রে একযোগে কয়েকটি ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়, যাতে প্রাণ যায় প্রায় তিন হাজার মানুষের।

নাইন-ইলেভেন নামে পরিচিত ওই হামলার অভিযোগে আফগানিস্তানে লুকিয়ে থাকা আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনকে হস্তান্তরের জন্য তালেবানকে অনুরোধ করে যুক্তরাষ্ট্র।

সাবেক মুজাহিদিন কমান্ডার আব্দুল রব রসুল সায়াফের আমন্ত্রণে আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন সৌদি নাগরিক ওসামা বিন লাদেন। তখন থেকে সেখানেই আত্মগোপনে ছিলেন তিনি।

ওসামাকে হস্তান্তরে ওয়াশিংটনের ওই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে তালেবান। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের কাছে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলায় বিন লাদেনের ভূমিকার প্রমাণ চায় গোষ্ঠীটি। পাশাপাশি ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনারও প্রস্তাব দেয়।

দুটি প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করে বুশ প্রশাসন। বিন লাদেনকে হস্তান্তর না করায় ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র।

এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের জোটবদ্ধ বিমান হামলার মুখে কয়েক মাসের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত হয় তালেবান।

তালেবান পরবর্তী আফগানিস্তান ও তালেবানের পুনরুত্থান

২০০১ সালের ডিসেম্বরে হামিদ কারজাইয়ের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে গঠিত হয় একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার।

এর তিন বছর পর প্রণয়ন হয় নতুন সংবিধান। ষাটের দশকের সংশোধিত সংবিধানের আলোকে তৈরি নতুন সংবিধানে নারী ও আদিবাসী সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হয়।

১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৭৩ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ৪৩ বছর আফগানিস্তান শাসন করেছিলেন বাদশাহ মোহাম্মদ জহির শাহ। দুররানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে দেশ শাসন করা জহির শাহ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রথমবার আফগান নারী ও আদিবাসী সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকারের অনুমোদন দিয়েছিলেন।

এদিকে প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের শাসনামলেই ২০০৬ সাল নাগাদ আবারও সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে তালেবান। বিদেশি সেনা ও তাদের আফগান সহযোগীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শুরু হয় যোদ্ধাদের এক ছাদের নিচে আনা।

দুই দশক কোণঠাসা থেকে নতুন করে শক্তি অর্জন

গত ২০ বছরে দেশজুড়ে অসংখ্য হামলা চালিয়েছে তালেবান। বেসামরিক মানুষের পাশাপাশি আফগান, এমনকি বিদেশি সেনাদের ওপরও হামলা চালিয়েছে গোষ্ঠীটি।

যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোটের হামলায় প্রাণ গেছে ৪০ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষের। নিহত হয়েছে আফগান সেনা ও পুলিশের কমপক্ষে ৬৪ হাজার সদস্য আর আন্তর্জাতিক জোটের সাড়ে তিন হাজারের বেশি সেনা।

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে শান্তি আলোচনার চেষ্টা

বিদেশি ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম এই যুদ্ধ আর অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে আমেরিকান সরকারের খরচ হয়েছে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার।

দিনে দিনে বেড়ে চলছিল আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের খরচ বেড়ে চললেও এখনও আফগানিস্তানে দারিদ্র্য প্রকট; ভঙ্গুর অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রায় সব খাত।

এ অবস্থায় ২০১১ সালে কাতারের দোহায় তালেবানের একাংশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন।

আফগানিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের সরকারের সঙ্গে তালেবানকে মুখোমুখি আলোচনায় বসানোর লক্ষ্যে হয় ওই আলোচনা।

এর ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে দোহায় তালেবানের একটি কার্যালয় চালু হয়।

কিন্তু পাঁচ বছরে আলোর মুখ দেখেনি রাজনৈতিক সমাধানের সেসব চেষ্টা।

আফগান সরকার ও তালেবানের দ্বন্দ্ব

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির বেসামরিক সরকারের সঙ্গে প্রথমবার আনুষ্ঠানিক ও সরাসরি আলোচনায় বসে তালেবান, কিন্তু লাভ হয়নি। কোনো সমঝোতাতেই পৌঁছাতে পারেনি কোনো পক্ষ।

শান্তিচুক্তি

শেষ পর্যন্ত আফগান সরকারের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি ছাড়াই গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র।

ওই চুক্তিতে আফগানিস্তানে নিরাপত্তা নিশ্চিতের শর্তে তালেবানবিরোধী সেনা অভিযান বন্ধ ও সেনা প্রত্যাহারের নিশ্চয়তা দেয় আন্তর্জাতিক জোট।

চুক্তিটির মাধ্যমে সে সময় আন্তর্জাতিকভাবে কিছুটা বৈধতা অর্জন করতে সক্ষম হয় তালেবান।

ট্রাম্পের উত্তরসূরি জো বাইডেনও ক্ষমতায় এসে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বদলাননি।

ফের আগ্রাসী রূপে তালেবান

চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের ১ মের মধ্যে বিদেশি সেনা পূর্ণাঙ্গ প্রত্যাহারের কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু তারিখ কিছুটা পিছিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর নেয় বাইডেন প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার ২০তম বার্ষিকীর সঙ্গে মিলিয়ে নতুন তারিখটি নির্ধারণ করা হয়েছিল।

সেনা প্রত্যাহারের তারিখ পেছানো নিয়ে ক্ষুব্ধ তালেবান মে মাসেই আগ্রাসন শুরু করে।

সহিংসতা বাড়তে থাকার পরিপ্রেক্ষিতে গত মাসে আবারও তারিখ পাল্টান বাইডেন। সময় কিছুটা এগিয়ে চূড়ান্ত সেনা প্রত্যাহারের নতুন তারিখ হিসেবে ৩১ আগস্ট নির্ধারণ করেন তিনি।

কিন্তু নমনীয় হয়নি তালেবান; চালিয়ে গেছে আক্রমণ। কিন্তু আক্রমণের লক্ষ্য ছিল মূলত আফগান সরকার, সেনাবাহিনী ও তাদের প্রতি বিশ্বস্তরা।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হওয়া চুক্তি মেনে এখন পর্যন্ত আমেরিকার নিরাপত্তা অবকাঠামো লক্ষ্য করে কোনো ধরনের হামলা চালায়নি গোষ্ঠীটি। কিন্তু আফগান সেনাবাহিনী ও জনসাধারণের ওপর চালিয়েছে একের পর এক প্রাণঘাতী হামলা।

গত এক মাসে তালেবান ও আফগান বাহিনীর সহিংসতায় এক হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। গৃহহীন হয়েছে কয়েক লাখ মানুষ।

ব্যর্থ শান্তি আলোচনা

যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান চুক্তির মাধ্যমে আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবানের শান্তি আলোচনার পথ খুলে যাবে বলে মনে করা হচ্ছিল। কাতারের রাজধানী দোহায় আলোচনা শুরুও হয়েছিল।

কিন্তু আফগান ভূখণ্ডে দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে তালেবান যোদ্ধাদের তীব্র সহিংসতার কারণে ভেস্তে যায় দোহার আলোচনা।

ব্যাখ্যা হিসেবে তালেবান জানিয়েছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে কোনো অবদান ছিল না পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থিত আফগান সরকারের।

মে মাসে আফগান সরকারের বিরুদ্ধে সহিংস অভিযান শুরু করে তালেবান। দখলে নিতে শুরু করে প্রতিবেশী দেশ ইরান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো।

আফগানিস্তানের ৪১৯টি জেলার অর্ধেকের বেশি এখন তালেবানের দখলে।

নতুন করে গৃহযুদ্ধের শঙ্কা

যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা, জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মাইলি গত মাসেই সতর্ক করে বলেছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে ‘কৌশলগত বিজয়’ অর্জনের পথে আছে তালেবান।

শান্তি আলোচনায় অচলাবস্থা আফগানিস্তানকে গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে শঙ্কা জোরালো হচ্ছিল তখন থেকেই।

বিভিন্ন অঞ্চলে কট্টরপন্থি তালেবানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়েছে স্থানীয় বেসামরিক আফগানরা। তাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণে সহযোগিতা করেছিল আফগান সরকার।

তালেবানের মুখপাত্র সোহেল শাহীন সে সময় জানান, গৃহযুদ্ধ চায় না তার দল। দোহায় শান্তি আলোচনা ফের শুরু করতে হলে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিকে পদত্যাগ করতে হবে বলে শর্ত বেঁধে দেন তিনি।

বার্তা সংস্থা এপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শাহীন বলেন, ‘একচেটিয়া ক্ষমতায় তালেবান বিশ্বাসী নয় বলে আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিতে চাই। তালেবান যোদ্ধারা অস্ত্র নামিয়ে রাখবে।

‘কিন্তু এটা তখনই সম্ভব, যখন আলোচনার ভিত্তিতে সর্বসম্মত কোনো সরকার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসবে।’

তালেবানের প্রধান হায়বতুল্লাহ আখুনজাদা গত সপ্তাহে ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’র আহ্বান জানান। কিন্তু সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান অব্যাহত রাখতে নিজ দলের যোদ্ধাদের মধ্যেই চাপের মুখে তিনি।

‘সমান্তরাল সরকার’

‘ইসলামিক আমিরাত অফ আফগানিস্তান’ নামে স্বঘোষিত সমান্তরাল রাষ্ট্র কায়েম করেছে তালেবান। নিজস্ব একটি সাদা পতাকাও আছে তাদের।

আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশে নিজেদের ছায়া সরকারের প্রশাসনকে নেতৃত্ব দিতে ছায়া গভর্নরও নিয়োগ দিয়েছে গোষ্ঠীটি।

তালেবানপ্রধান একটি পরিষদে নেতৃত্ব দেন। পরিষদটি অর্থ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ ১২টির বেশি কমিশন দেখভালের দায়িত্ব পালন করে। তাদের নিজস্ব আদালত ব্যবস্থাও আছে।

তালেবান সদস্য ও জাতিসংঘের একটি কমিটির তথ্য অনুযায়ী, তালেবানের এ ছায়া সরকারের বার্ষিক আয় প্রায় দেড় শ কোটি ডলার।

আঞ্চলিক মাদক ব্যবসায় জড়িত স্থানীয় ও আঞ্চলিক বিভিন্ন অপরাধী চক্রের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতেও রাজস্ব পায় তালেবান। মেথামফেটামিনধর্মী এক ধরনের মাদক উৎপাদনও করে গোষ্ঠীটি। গত বছর খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও বিক্রি থেকেও শত-কোটি ডলার আয় করেছে তারা।

তালেবানের নিজস্ব কর সংগ্রহ ব্যবস্থা আছে। বিদেশ থেকেও বিপুল অঙ্কের অনুদান পায় তারা। ধারণা করা হয়, ইরান ও পাকিস্তানে তালেবানের অনেক আর্থিক পৃষ্ঠপোষক আছে। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করে গোষ্ঠীটি।

তালেবান শাসনের ভবিষ্যৎ

বিদেশি সেনা প্রত্যাহার পুরোদমে শুরুর আগেই এবং শান্তি আলোচনা চলাকালে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সহিংসতায় হতাহত হয়েছে এক হাজার ৮০০ বেসামরিক আফগান। গত বছরের তুলনায় এ সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।

গুপ্তহত্যার শিকার অনেক সংবাদকর্মী। অনেক অধিকারকর্মীর মৃত্যুও হয়েছে। এ জন্য তালেবানের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়েছে সমালোচকরা। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে গোষ্ঠীটি।

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জোটের সেনারা পূর্ণরূপে আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর কী ঘটবে, তা নিয়ে।

২০১৯ সালের উল্লেখযোগ্য একটি জনমত জরিপে উঠে এসেছে, বর্তমানে তালেবানের প্রতি কোনো রকম সহানুভূতি রাখেন না এমন আফগান ৮৫ শতাংশ।

আফগানিস্তানে আবারও তালেবান পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলে দেশটিতে জনজীবনের কী হাল হবে, তা নিয়ে শঙ্কিত আফগানরা।

এমনকি সাধারণ নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা সংবিধানটি তালেবান ছুড়ে ফেলে দেবে কি না, ঘনিয়ে উঠছে সে শঙ্কাও।

নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি উপসম্পাদকীয়তে বলা হয়, এ বিষয়ে মোটামুটি স্বচ্ছ ধারণা দিয়ে রেখেছে তালেবান। তারা জানিয়েছে যে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা। সে ব্যবস্থায় শিক্ষা থেকে শুরু করে পেশাগত বিষয় পর্যন্ত সবকিছুতে নারীরা কেবল ততটুকু অধিকারই পাবেন, যতটুকু ইসলাম ধর্মে তাদের দেয়া হয়েছে।

যদিও তালেবান মুখপাত্র শাহীন চলতি সপ্তাহের শুরুতে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘হিজাব বা মাথা ঢাকা পোশাক পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্মক্ষেত্রে যাওয়া, এমনকি রাজনীতিতেও অংশ নিতে পারবেন নারীরা।’

বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত দেশে আগে থেকেই এ চর্চা বিদ্যমান।

নাইন-ইলেভেন হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপে তালেবানের নব্বইয়ের দশকের শাসনামল স্থায়ী হয়েছিল ছয় বছর।

যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জোটের সেনাদের অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় দফায় তালেবানের শাসন কতটা দীর্ঘ হবে, তা নিয়েও শঙ্কিত বিশ্ব।

এ বিভাগের আরো খবর