অবরুদ্ধ গাজার উদ্দেশে ত্রাণবাহী বহরের একমাত্র জাহাজটিকেও আটক করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের উপকূলে এই ঘটনাটি ঘটে। গতকাল শুক্রবার সকালে একটি লাইভস্ট্রিম ভিডিওতে দেখা যায়, ইসরায়েলি বাহিনী জোর করে জাহাজটিতে ওঠে।পোল্যান্ডের পতাকাবাহী ‘ম্যারিনেট’ নামের ওই জাহাজটিতে ছয়জন ক্রু রয়েছেন বলে জানা গেছে। এটি ছিল গ্লোবাল সামুদ ফ্লোটিলার শেষ কার্যকর নৌযান। এক সময়ের ৪৪টি জাহাজ নিয়ে গঠিত বহরের সর্বশেষ জাহাজ।এর আগে, বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জাহাজটির ক্যাপ্টেন একটি ভিডিও বার্তায় জানান, কিছুক্ষণ আগে ইঞ্জিনে যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তবে সেটি মেরামত করা হয়েছে এবং এখন জাহাজটি সম্পূর্ণ সচল রয়েছে। ফ্লোটিলা আয়োজকরা আরও জানিয়েছেন, ম্যারিনেট এখনো স্টারলিঙ্ক স্যাটেলাইট সংযোগের মাধ্যমে যোগাযোগে রয়েছে। এর সঙ্গে সরাসরি লাইভস্ট্রিমও সচল রয়েছে, যা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ রিয়েলটাইমে পর্যবেক্ষণ করতে পারছেন।জাহাজটি ফিরে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা করছে না বলেও জানানো হয়েছে আয়োজকদের পক্ষ থেকে। ইনস্টাগ্রামে প্রকাশিত এক পোস্টে তারা লিখেন, ম্যারিনেট শুধু একটি জাহাজ নয়। এটি সাহসের প্রতীক। এটি ভয়, অবরোধ এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি।পোস্টে আরও বলা হয়, গাজা একা নয়। ফিলিস্তিনকে কেউ ভুলে যায়নি। আমরা কোথাও যাচ্ছি না।উল্লেখ্য, ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ ছিল একটি শান্তিপূর্ণ মানবিক মিশন, যার লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের অবরোধ ভেঙে সরাসরি গাজার মানুষের কাছে ওষুধ ও খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা পৌঁছে দেওয়া। আগস্টের শেষ দিকে যাত্রা শুরু করা এই নৌবহরে ৪০টির বেশি বেসামরিক জাহাজ অংশ নেয়। এর মধ্যে ছিল আইনজীবী, চিকিৎসক, সংসদ সদস্য, মানবাধিকার কর্মীসহ নানা দেশের প্রতিনিধিরা।ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে ওই বহরের অধিকাংশ জাহাজকে আটক করেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় ৪৫০ জন আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবককে। এদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি হলেন সুইডিশ জলবায়ু অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, যাকে সম্প্রতি একটি জাহাজ থেকে সশস্ত্র ইসরায়েলি সেনারা আটক করে। গ্রেপ্তারের আগে রেকর্ড করা এক ভিডিও বার্তায় থুনবার্গ বলেছিলেন, যদি আপনি এই ভিডিও দেখেন, তাহলে বুঝবেন আমি অপহৃত হয়েছি এবং ইসরায়েলি বাহিনী আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে।এই ঘটনায় বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ইতোমধ্যে তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, ইতালিসহ বহু দেশ নিন্দা জানিয়েছে। ইউরোপজুড়ে রাস্তায় নেমেছে হাজারো মানুষ। ইতালি ডেকেছে সাধারণ ধর্মঘট। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান এই অভিযানে ইসরায়েলকে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং এই আক্রমণকে ‘গাজার ক্ষুধার্ত শিশুদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা’ বলে অভিহিত করেছেন।অন্যদিকে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, তারা শুধু একটি বৈধ সামরিক অবরোধ রক্ষা করছে এবং এই নৌবহর ছিল ‘উসকানিমূলক অভিযান’। তারা বলেছে, যেকোনো সহায়তা তাদের নির্ধারিত নিরাপদ রুটের মাধ্যমেই গাজায় পাঠানো যেতে পারে।তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ইসরায়েল যে অবরোধ আরোপ করে রেখেছে, তা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও জাতিসংঘ ঘোষিত ‘জেনোসাইড কনভেনশন’-এর লঙ্ঘন।ইসরায়েলে আটক গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার অভিযাত্রীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশন শুরু করেছেন। গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি) কমিটি।বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েলের নৌবাহিনী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা মিশনের নৌযানগুলো এবং ক্রু ও অভিযাত্রীদের আটকের প্রতিবাদে অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশন শুরু করেছেন মিশনের অভিযাত্রীরা।’ফিলিস্তিনের যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার বাসিন্দাদের জন্য খাদ্য ও ওষুধ নিয়ে গত ৩১ আগস্ট স্পেনের বন্দর থেকে গাজার উপকূলের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ মিশনের অন্তর্ভুক্ত ৪৩টি নৌযান। সুইডেনের নাগরিক এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ আন্দোলন কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি ও রাজনীতিবিদ মান্ডলা ম্যান্ডেলাসহ ৪৪টি দেশের ৫০০ জন নাগরিক ছিলেন সেই মিশনে। এই নাগরিকদের কেউ পার্লামেন্টারিয়ান, কেউ আইনজীবী, কেউ রাজনৈতিক আন্দোলনকর্মী এবং কেউ বা স্বেচ্ছাসেবী।কিন্তু গাজার জলসীমায় কাছাকাছি যাওয়ারি পরপরই একটি ব্যতীত সবগুলো নৌযান আটক করে ইসরায়েলের নৌবাহিনী। নৌযান, ক্রু এবং আরোহীদের নিয়ে যাওয়া হয় ইসরায়েলের বন্দরে।গত বুধবার রাতে প্রথমে ১৩টি নৌযান আটকায় ইসরায়েলের নৌবাহিনী; কিন্তু তারপরও বাকি ৩০টি নৌযান গাজার উদ্দেশে এগিয়ে যাচ্ছিল। পরের দিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একে একে ২৯টি নৌযান আটক করে ইসরায়েলের নৌসেনারা। সর্বশেষ নৌযানটিকে আটক করা হয়েছে আজ শুক্রবার সকালে।এফএফসির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বুধবার যেদিন অভিযাত্রীদের আটক করা শুরু হয়, সেদিনই অনশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা।এদিকে ইসরাইলের দীর্ঘদিনের অবরোধ ভাঙতে গাজা অভিমুখে যাত্রা করেছে আরও ১১টি জাহাজের একটি বহর। আন্তর্জাতিক অধিকার সংগঠন ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের (এফএফসি) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই মিশনে অংশ নিয়েছেন প্রায় ১০০ জন সাংবাদিক, চিকিৎসক ও অধিকারকর্মী। এ খবর দিয়েছে তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু। এতে বলা হয়, ‘কনসায়েন্স’ নামের প্রধান জাহাজটি ৮টি ছোট নৌকা নিয়ে গত ৩০ সেপ্টেম্বর রওনা দেয়। পরে এতে যুক্ত হয় ‘থাউজেন্ড ম্যাডলিনস টু গাজা’ নামের আরেকটি বহর, যার সঙ্গে ছিল ফ্রান্স ও ইতালির পতাকাবাহী দুটি জাহাজ। বহরটি বর্তমানে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের ক্রিট দ্বীপ উপকূলে অবস্থান করছে।এই মিশনে বাংলাদেশ থেকে যোগ দিয়েছেন আলোকচিত্রী ও দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল আলম। ফ্লোটিলা কোয়ালিশন জানিয়েছে, ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘন, সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা এবং গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থার ধ্বংসের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ জানাতে এই যাত্রা। এদিকে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার সর্বশেষ জাহাজটিও গাজার উপকূলে পৌঁছানোর পর শুক্রবার আটক করেছে ইসরাইলি বাহিনী। এর আগে একইভাবে অন্য জাহাজগুলোরও নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা।ফিলিস্তিনের গাজা অভিমুখে যাত্রা করা ত্রাণবাহী নৌবহর ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’র সবগুলো নৌযান আটকানোর ঘটনায় বিশ্বজুড়ে ব্যাপক নিন্দা জানানো হয়েছে। ইউরোপ থেকে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত দেশে দেশে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমে ইসরায়েলের পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞার দাবি তোলেন।ফ্লোটিলা আটকানোর ঘটনায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘আন্তর্জাতিক জলদস্যুতার’ অভিযোগ তুলেছেন ফিলিস্তিনি এক আইনজীবী।গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ইসরায়েলের নৌ অবরোধ ভেঙে সমুদ্রপথে গাজায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার একটি বৈশ্বিক প্রচেষ্টা। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার প্রথম বহর ৩১ আগস্ট স্পেনের বার্সেলোনা থেকে যাত্রা শুরু করে।জাতিসংঘ জানিয়েছে, প্রায় দুই বছরের যুদ্ধ শেষে গাজায় দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই নৌবহরের উদ্দেশ্য ছিল অবরুদ্ধ গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানো এবং অবরোধকে চ্যালেঞ্জ জানানো।ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘আন্তর্জাতিক জলদস্যুতার’ অভিযোগ তুলে ফিলিস্তিনি মানবাধিকার আইনজীবী ডায়ানা বুট্টু বলেছেন, ইসরায়েলের ফ্লোটিলা আটকানোর ঘটনা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ।আল–জাজিরার সহপ্রকাশনা এজে প্লাসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডায়ানা বুট্টু বলেন, সব জাহাজই আন্তর্জাতিক জলসীমায় অবস্থান করছিল। সেখানে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর বিদেশি পতাকা বহনকারী জাহাজে ওঠা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।এই আইনজীবী অভিযোগ করেন, ফ্লোটিলা থেকে যাত্রীদের আটক করে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যেখানে তাদের যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এরপর তাদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে প্রবেশের মামলা দিয়ে আবার বহিষ্কার করা হচ্ছে।
ফ্লোটিলার সবশেষ জাহাজটিও আটক করল ইসরায়েল
এ বিভাগের আরো খবর/p>