আফগানিস্তানের প্রধান কয়েকটি শহর দখলের পর প্রথমবারের মতো তালেবানের কোনো শীর্ষ নেতা হিসেবে চীন সফর করেছেন দলটির সহপ্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আবদুল ঘানি বারাদার। কাতারে তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের দায়িত্বে থাকা এই গুরুত্বপূর্ণ নেতা বুধবার চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং য়ির সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে জানিয়েছে দেশটির গণমাধ্যম।
বৈঠকে আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে তালেবানের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। তবে শর্ত হিসেবে শিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় লড়াই করা ইস্ট তুর্কেস্তান ইসলামিক মুভমেন্টের (ইটিআইএম) সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে তালেবানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশটি।
বুধবার হংকংভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
চীনের উত্তরাঞ্চলের শহর তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে তালেবান নেতা আব্দুল ঘানি বারাদারের নেতৃত্বে নয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল অংশ নেন। এসময় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং য়ি আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সামরিক জোট ন্যাটোর সেনা প্রত্যাহারের ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থ নীতির ফলাফল হিসেবে অভিহিত করেন। একই সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতেও তালেবানকে আহ্বান জানান তিনি।
ওয়াং য়ি বলেন, ‘তালেবান আফগানিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি। দেশের শান্তি, সংহতি ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়াতেও গোষ্ঠীটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
চীন আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে সমর্থন করবে জানিয়ে তালেবানকে ইটিআইএমের সঙ্গে সম্পর্কছেদের আহ্বান জানান ওয়াং য়ি।
তিনি বলেন, ‘ইটিআইএম জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের তালিকাভুক্ত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন। এটি চীনের জাতীয় নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি সরাসরি হুমকি।
‘ইটিআইমের বিরুদ্ধে লড়াই করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কর্তব্য। আমি আশা করি তালেবান এ ধরনের সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। ইটিআইমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তালেবান শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। একই সঙ্গে এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নেও সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।’
চীনের তিনজিয়ান শহরে তালেবান নেতাদের সঙ্গে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং য়ি। ছবি: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট
তালেবানের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাইম জানিয়েছেন, চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে দুই দেশের মধ্যকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ইস্যু ও শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
তিনি এক টুইট বার্তায় বলেছেন, তালেবানের প্রতিনিধি দল চীনকে নিশ্চিত করেছে যে আফগানিস্তানের মাটি অন্য কোনো দেশের নিরাপত্তায় হুমকি তৈরিতে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রসহ সামরিক জোট ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো আফগানিস্তান থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহারের শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
চলতি বছরের ৩১ আগস্টের মধ্যে নিজেদের সব সেনা সরানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিদেশি সব সেনা আফগানিস্তান ছাড়ার মধ্যেই দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল দখলে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে তালেবান। আফগান সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই তাদের সংঘর্ষ বাঁধছে।
ইতোমধ্যে চীনের শিনজিয়াং প্রদেশের পাশের সীমান্ত অঞ্চলসহ দেশের প্রায় অর্ধেক এলাকা দখল করেছে তালেবান। আফগান সরকারের সমর্থনে এখনও তালেবান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে বিমান হামলা চালু রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।
এমন পরিস্থিতিতে চীন গভীর মনোযোগের সঙ্গে আফগানিস্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছে দেশটির গণমাধ্যম। কেননা আফগানিস্তান সংলগ্ন শিনজিয়াংয়ে চীনের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। চীনের উদ্বেগ, তালেবান শিনজিয়াংয়ের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা করলে অঞ্চলটিতে নিয়ন্ত্রণ বিঘ্নিত হতে পারে।
চীনের শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুরদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার কথা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় নেতা, অধিকারকর্মী ও সরকারগুলো বলে আসছে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০ লাখেরও বেশি উইঘুরকে ক্যাম্পে বন্দি করে রেখেছে চীন।
তবে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের লক্ষ্যে অভিযোগ করা হচ্ছে জানিয়ে চীন বরাবরই সেগুলো নাকচ করে আসছে।
দেশটির ভাষ্য, সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদ বিরোধী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ক্যাম্পগুলোকে মূলত কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
অতীতে শিনজিয়াংয়ের উইঘুর মুসলমানের আন্দোলনে সমর্থন দিলেও তালেবান ঘোষণা দিয়েছে তারা চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা আর নাক গলাবে না।
চীনের নর্থ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের শিক্ষক ইয়ান ওয়েইর মতে, তালেবান ও চীনের মধ্যে সুসম্পর্ক দুই পক্ষের জন্যই জরুরি।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘তালেবান সরকার গঠন করুক আর না করুক তারা আফগানিস্তানের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে প্রধান ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে।’
ইয়ান ওয়েই বলেন, ‘তালেবান আফগানিস্তানের অন্য জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোকে দমন করবে। গোষ্ঠীটির মাধ্যমে চীনও অন্য জঙ্গীদের ওপর চাপ বজায় রাখতে পারবে। এটি চীনসহ আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রাখবে।’