নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে গো হারা হেরে, এখন নানাভাবে রাজ্য সরকার, তৃণমূল কংগ্রেস এবং সর্বোপরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চাপে রেখে, নিজেদেরকে চাঙ্গা রাখার কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাজ্যে তৃতীয়বারের জন্য সরকার গঠন করেছে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস। আর বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সরকার গঠনের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। তাই তৃণমূল আর মমতাকে আক্রমণের পথে হেঁটে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়েছে বিজেপির নেতৃত্ব।
তার টাটকা উদাহরণ উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা দেওয়ার ঘটনা। সেটি হাতিয়ার করে রাজ্যে উপনির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দাবি তুলতে পারে, তবে বিজেপি রাজ্যে উপনির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার প্রস্তাব হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছে।
ঘটনা হলো উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী তীর্থ সিং রাওয়াত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত বিধানসভার নির্বাচিত সদস্য না হয়েও মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসেছিলেন। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী তাকে ছয় মাসের মধ্যে কোন কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়ে আসতে হতো। রাওয়াতের হাতে সময় ছিল দু’মাস। তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়েছেন। করোনা সঙ্কটকালে মানুষের কথা ভেবে উপনির্বাচনে না গিয়ে, মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বলে প্রচার করছে বিজেপি।
বিজেপির দাবি হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরও উচিত করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কথা মাথায় রেখে, এখনই উপনির্বাচনে না যাওয়া। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের উপনির্বাচন, কমিশন পিছিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমস্যায় পড়তে পারেন।
কেননা সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী তাকেও নির্বাচিত হয়েই আসতে হবে ছয় মাসের মধ্যে। অন্যথায় রাজ্য সরকার প্রশাসনিক সংকটে পড়বে। সংকটে পড়বে তৃণমূল নেতৃত্ব।
বিজেপির উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী করোনাকালে নির্বাচনে না গিয়ে মানুষের জন্য সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে, বিজেপি নির্বাচন কমিশনে এখনই নির্বাচন না করার আর্জি জানিয়ে মমতাকে চাপে রাখার চেষ্টা করতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত ।
রাজ্যে ভোটের ফলে টার্গেটে না পৌঁছতে পেরে বিজেপির অন্দরের সংঘাত এখন চরম আকার নিয়েছে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো, রাজ্যে বিজেপির মজবুত সংগঠন, ভোটের ফল প্রকাশের পর সেই সংগঠনের প্রকৃত চেহারাটা সামনে এসেছে।
একের পর এক বিজেপির নেতাকর্মী দল ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন। বিজেপি ভেঙে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় বহু নেতাকর্মী। দলে ভাঙন রোধে মরিয়া বিজেপি, রাজ্যে তাদের সংগঠন ধরে রাখতে মমতার সরকারকে আক্রমণই তারা লক্ষ্য করে নিয়েছে। এখন রাজ্য সরকারকে যে কোনভাবেই বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে বিজেপি।
রাজ্যে দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন না করে, ভোট পরবর্তী সহিংসতা নিয়ে বিজেপি একের পর এক অভিযোগ তুলে, রাজ্যপালকে দিয়ে, জাতীয় হিউম্যান রাইটস কমিশনকে দিয়ে, রাজ্যকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করলেও রাজ্যে ভোট পরবর্তী সহিংসতার ইস্যুটা তেমন জমেনি বলে দাবি তৃণমূলের।
তাই এবার টিকা জালিয়াতি কাণ্ড নিয়ে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দিয়েছে বিজেপি।
আগামীকাল সোমবার করোনা বিধি ভেঙে, কলকাতা পৌরসভা ঘেরাও কর্মসূচি নিয়েছে তারা। কসবার ভুয়া টিকা কাণ্ড নিয়ে বিজেপি ইতিমধ্যে সিবিআই তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে গেছে। হাইকোর্ট মামলা গ্রহণ করেছে।
অন্যদিকে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা দেয়ার ঘটনা সামনে এনে উপনির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে মমতাকে নতুন করে সংকটের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে বিজেপি। এমন মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের ।
তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব এমনকি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও বিজেপির এই আচরণের বিরোধিতা করে বলেছেন, ‘বিজেপি হার মেনে নিতে না পেরে এসব করছে। সহিংসতায় উস্কানি দিচ্ছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উস্কানি দিচ্ছে। বিজেপি একটা সাম্প্রদায়িক দল।’
তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় বলেন, ‘ভোটে হেরে বিজেপি প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে। রাজ্য সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে বিজেপি।’
তবে বিজেপির এই উত্তরাখণ্ড কৌশলকে মোটেও গুরুত্ব দিতে রাজি নয় তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা। তাদের বিশ্বাস, রাজ্যে করোনা সংক্রমণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। এই আবহে নির্বাচন কমিশন দ্রুত উপনির্বাচন করে ফেলবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রাম কেন্দ্রে হেরে গিয়েও মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী তাকে ছ মাসের মধ্যে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে।
তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায় এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করোনাকে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করা সত্ত্বেও এ রাজ্যে আট দফায় ভোট হয়েছে। এখন সেখানে করোনা সংক্রমণের হার ২ শতাংশ। ওই সময় যদি আট দফায় ভোট হতে পারে, তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজ্যে নির্বাচন করতে বাধা নেই বলে আমরা মনে করি । মুখ্যমন্ত্রীকে ৬ মাসের মধ্যে জিতে আসতে হবে। এখনও তার হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে। আমাদের আশা, নির্বাচন কমিশন তার আগেই রাজ্যে উপনির্বাচন করবে।’
অন্যদিকে উত্তরাখণ্ডের বিধানসভার মেয়াদ শেষ হচ্ছে এ বছর ডিসেম্বরে। আর তীর্থ সিং রানাওয়াতের হাতে সময় ছিল মাত্র দু’মাস। এত অল্প সময়ের জন্য নির্বাচন কমিশন উপনির্বাচন করায়না। তাছাড়া বিরোধীদের দাবি তীর্থ সিং রাওয়াতকে দিয়ে সরকারের দুর্নীতি ঢাকা যায়নি। তাই উপনির্বাচনে না গিয়ে, মুখ্যমন্ত্রী বদল করে, সরকারের ভাবমূর্তি উদ্ধার করে, উত্তরাখণ্ডে সামনের বছরের বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিজেপি। করোনার দোহাই দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছেন তীর্থ।
একদিকে নতুন মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামিকে দিয়ে উত্তরাখণ্ডের ভাবমূর্তি সংস্কার, অন্যদিকে তীর্থ সিং রাওয়াতের উদাহরণ তুলে পশ্চিমবঙ্গের উপনির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে তৃণমূলকে কোণঠাসা করার কৌশল নিতে চাইছে বিজেপি।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পিছনের দরজা দিয়ে পৌরসভাগুলোর ক্ষমতা দখল করে রেখেছে শাসকদল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের সুবিধার কথা ভেবে উপনির্বাচনের কথা বলছেন। কিন্তু পুরোভোট করার ব্যাপারে কেন তিনি উদ্যোগী হচ্ছেন না।’
কিন্তু উত্তরাখণ্ডের বিধানসভার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সামনের বছরের শুরুতে সেখানে ভোট। মুখ্যমন্ত্রী রাওয়াতের হাতে দু’মাস সময় ছিল উপনির্বাচনে জিতে আসার জন্য। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা সদ্য শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে। ফলে সবদিক দিয়ে দুটো বিষয় আলাদা বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মত।