কানাডার আদিবাসী শিশুদের এক সময় জোর করে আবাসিক স্কুলে ভর্তি করানো হতো। ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত ওইসব স্কুলে শিক্ষার্থীদের জীবন ছিল আধাসামরিক ধাঁচের। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রার্থনা, লাইনে দাঁড়ানো, নিয়মিত মার খাওয়ার মধ্য দিয়ে স্কুলজীবন পার হতো তাদের।
আবাসিক স্কুলে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাওয়া আদিবাসী শিক্ষার্থীরা বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এভাবেই নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলেন ।
সম্প্রতি কানাডার পশ্চিমাঞ্চলে পরিত্যক্ত এক আবাসিক স্কুল থেকে ২১৫ শিশুর দেহাবশেষ উদ্ধারের ঘটনা দেশটির আদিবাসীদের তিক্ত অভিজ্ঞতা ফের মনে করিয়ে দেয়। রাডারের মাধ্যমে ওই শিশুদের গণকবরের খোঁজ পাওয়া যায়।
সরকারি নীতি অনুযায়ী কানাডার আদিবাসী শিশুদের জোর করে পরিবার থেকে আলাদা করে আবাসিক স্কুলে ভর্তি করানো হতো। পরে ওই নীতির নাম দেয়া হয় ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’।
১৮৩১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকা ওই নীতির কারণে প্রায় দেড় লাখ আদিবাসী শিশুকে তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়।
ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত আবাসিক স্কুলগুলো নিয়ে কয়েক বছর আগে তদন্ত করে কানাডিয়ান ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন (টিআরসি)।
২০১৫ সালে কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, শিশুরা ওইসব স্কুলে অপুষ্টিতে ভুগত। নিয়মিত তাদের পেটানো ও গালাগাল দেয়া হতো। ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’ নামের ব্যবস্থার অংশ হিসেবে এসব করা হতো।
কানাডার মানিটোবা অঙ্গরাজ্যের লং প্লেইন ফার্স্ট নেশন রিসার্ভে বেড়ে ওঠেন রুথ রুলেট।
৬৯ বছর বয়সী রুলেট স্মৃতি ঘেঁটে রয়টার্সকে বলেন, প্রথমবার গাড়িতে চড়তে পেরে খুব আনন্দিত ছিলেন তিনি ও তার ভাইবোনেরা। লেক মানিটোবার কাছে স্যান্ডি বে আবাসিক স্কুলে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। স্কুলে পৌঁছার পরপরই ভাইদের কাছ থেকে রুলেট ও তার বোনদের বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং তাদের চুল কেটে দেয়া হয়।
টিআরসির তথ্য অনুযায়ী, স্কুলে নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল শিশুদের। পরিবারের দেয়া নাম বাদ দিয়ে ইউরোপীয় নাম দেয়া হতো তাদের।
রুলেট বলেন, স্কুলের প্রথম দিন খ্রিষ্টান এক সন্ন্যাসিনী তাকে পেন্সিল ও কাগজ দেন। কাগজে লেখার গতি ধীর হওয়ায় একপর্যায়ে তার মুখে ঘুষি মারেন ওই সন্ন্যাসিনী।
রুলেট বলেন, ‘চারদিক রক্তে ভেসে যায়। আমি বুঝছিলাম না, কী ভুলটা আমি করেছি। আমি শুধু কাঁদছিলাম। রক্ত আমাকেই পরিষ্কার করতে হয়।’
তিনি বলেন, তিনি ও তার বন্ধুরা স্কুল থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান। পালানোর চেষ্টা করায় তাদের মারধর করা হয়। এক সপ্তাহ তাদের শুধু গাজর খেতে দেয়া হয়।
রুলেট বলেন, ‘অদিবাসী শিশুদের শিশুর মতো থাকার সুযোগ ছিল না।’
স্কুলে ছাত্রদের ছুতার কাজসহ হাতেকলমে অন্যান্য শিক্ষা দেয়া হতো। আর ছাত্রীদের গৃহস্থালি কাজের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো।
২০০৮ সালে আদিবাসী শিশুদের নিপীড়নের ঘটনায় ক্ষমা চায় কানাডা সরকার।
গত মাসে কানাডার পশ্চিমাঞ্চলে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া অঙ্গরাজ্যে পরিত্যক্ত ক্যামলুপস ইন্ডিয়ান রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে শিশুদের দেহাবশেষ পাওয়ার ঘটনায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দুঃখ প্রকাশ করেন। ক্যাথলিক চার্চকে ওই ঘটনার দায় নিতে বলেন তিনি।
ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় শিশুদের দেহাবশেষ পাওয়ার ঘটনা বেদনাহত করেছে বলে জানান খ্রিষ্টানদের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস। তবে ওই ঘটনার জন্য ক্ষমা চাননি তিনি।
ক্যামলুপস স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে শিশুদের দেহাবশেষ পাওয়ার ঘটনায় কানাডিয়ান কনফারেন্স অফ ক্যাথলিক বিশপস এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।