প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীরা নন, ভারতে ভোটের সময় নির্বাচন কমিশনই শেষ কথা বলে। পাঁচ রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা ভোটের আগে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন সে কথাই আবার প্রমাণ করছে। সমালোচনা হলেও কমিশন অটল তাদের ভাবমূর্তি রক্ষায়।
২৭ মার্চ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও অসম, কেরালা, তামিলনাডু ও পুদুচেরিতে ভোট শুরু হচ্ছে। ভোট গণনা হবে ২ মে। পাঁচ রাজ্যের ৮২৪টি কেন্দ্রে ভোট দেবেন ১১ কোটি ৩৮ লাখ ৫৯ হাজার ৬০ জন।
ভারতে ভোটের দিন ঘোষণার পরই আচরণবিধি মেনে চলা শুরু হয়। নির্বাচিত সরকারের তখন আর নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা ঘোষণার সুযোগ থাকে না। এমনকি নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে এমন সিদ্ধান্তও নেয়া যায় না।
তাই ভোট ঘোষণার দিনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আর এটি পুরোপুরি নির্ভর করে কমিশনের মর্জির ওপর। গোপন রাখা হয় ভোট ঘোষণার সময়সূচি। ফলে আগে থেকে কেউ জানতে পারেন না। রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্দাজের ওপরেই নির্ভর করতে হয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এবার জানতে পারেননি ভোটের সময়সূচি ঘোষণার দিন। তাই অসম সফরের সময় বলেছিলেন, মার্চের প্রথম সপ্তাহে ভোট ঘোষণা হতে পারে।
কিন্তু খোদ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ভুল প্রমাণ করে ২৭ ফেব্রুয়ারি সময়সূচি ঘোষণা দেয় নির্বাচন কমিশন। চালু হয় আচরণবিধি। পাঁচ রাজ্যের প্রশাসন পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের কাছেই দায়বদ্ধ। মন্ত্রীরা সরকারি কাজ ছাড়া কোনো প্রোটোকল পাবেন না।
নিরাপত্তার কারণে অনেকটাই ছাড় পান প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী। তবে তাদের যাতায়াতের খরচ দলকেই দিতে হয়। ভোটের সময় সবাই সমান। রাজনৈতিক দলগুলো সর্বোচ্চ কত টাকা খরচ করতে পারবে সেটিও ঠিক করে দেয় নির্বাচন কমিশন। এটি তদারক করেন কমিশনের পর্যবেক্ষকরা।
ভোটের সময়সূচিও হয় কমিশনের মর্জিতেই। যেমন পশ্চিমবঙ্গে ৮ দফায় ভোট হবে। অসমে হচ্ছে ৩ দফায়। কিন্তু তামিলনাডু, কেরালা ও পুদুচেরিতে এক দিনেই ভোট শেষ। এ ক্ষেত্রে কমিশন নিরাপত্তা বাহিনীর চাহিদাকে গুরুত্ব দেয়।
পশ্চিমবঙ্গে ভোটারের সংখ্যা ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৭ হাজার ৮৩২ জন। তামিলনাডুতে ৬ কোটি ২৮ লাখ ২৩ হাজার ৭৪৯ জন। অসমের ভোটার ২ কোটি ৩২ লাখ ৪৪ হাজার ৪৫৪ জন। কিন্তু অসমে ভোট হচ্ছে ৩ দফায়। তামিলনাডুতে ১ দফায়।
নির্বাচনি সময়সূচি অনুযায়ী ২৭ মার্চ বেশির ভাগ আসনেরই ভোট নেয়া শেষ হবে। কিন্তু গণনা হবে ২ মে।
এ সময়ে তিন স্তরের নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে রাখা হবে জনগণের মত। এই পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি নেই রাজনৈতিক দলগুলোরও।
২০০৪ সাল থেকে ভারতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেয়া হয়।
২০১৭ সালে ইভিএমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপ্যাট)। এর সাহায্যে নিজের দেয়া ভোট যাচাই করে নিতে পারেন ভোটাররা। এতে সহজ হয়েছে ভোটগণনা। সুবিধা বেড়েছে ভোট গ্রহণেও।
ইভিএম নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন ইভিএমে ভোট বদলে ফেলা যায়। এ নিয়ে মামলাও হয়েছে। পরে কমিশনও চ্যালেঞ্জ জানায় প্রযুক্তিবিদদের। কিন্তু কেউই প্রমাণ করতে পারেনি ইভিএমে জালিয়াতি করা যায়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দেখিয়েছে, ইভিএমে নেয়া ভোটে ২০০৪ সাল থেকে বিভিন্ন নির্বাচনে জয় পেয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। কোনো একটি বিশেষ জাতীয় বা আঞ্চলিক দল নয়, বহুদলীয় ব্যবস্থায় বিজেপি, কংগ্রেস, বাম, তৃণমূলসহ সব দলই জিতেছে। আবার হেরেছেও।
নির্বাচন কমিশনের দাবি, ইভিএম জালিয়াতি হলে ভোটের ফলে হেরফের হতে পারে না। বিধানসভা ভোটের পাশাপাশি লোকসভাতেও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। জিতেছে কংগ্রেস বা বিজেপি উভয় দলই। হেরেছেও। তাই আত্মবিশ্বাসী নির্বাচন কমিশন।
নিরপেক্ষতার প্রশ্নে বেশ সক্রিয় ভারতের নির্বাচন কমিশন। তৃণমূল স্তর থেকে রাজ্যস্তর পর্যন্ত পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেন তারা। অন্য রাজ্য থেকে আসা পর্যবেক্ষকদের হাতে থাকে প্রচুর ক্ষমতা।
এই পর্যবেক্ষকদের প্রতিবেদনের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এখন কমিশন প্রতি রাজ্যেই পুলিশের নিরপেক্ষতা দেখতে পুলিশ পর্যবেক্ষক, কালো টাকা রোধে আর্থিক পর্যবেক্ষক এবং সামগ্রিক বিষয় দেখতে সাধারণ পর্যবেক্ষকরা থাকেন।
পুলিশ ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ দেখা দিলেই কড়া ব্যবস্থা নেয় কমিশন। একদম নিচুতলা থেকে ওপরতলা পর্যন্ত সবাই কমিশনের ভয়ে তটস্থ থাকেন। ভোটের সময় বদলি ও বরখাস্ত হওয়া ভারতে খুব সাধারণ ঘটনা।
এবারও একই পরম্পরা চলছে। ভারতে পুলিশের প্রধান পদের নাম ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ বা ডিজিপি। তিনি আইজিপির চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান। পশ্চিমবঙ্গের ডিজিপিকেও বদলি করেছে কমিশন।
৯ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের ডিজিপি বীরেন্দ্রকে হঠিয়ে নতুন ডিজিপি হিসাবে পি নিরঞ্জনকে দায়িত্ব দেয় কমিশন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি চোট পাওয়ার ঘটনায় তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিনিয়র পুলিশ অফিসার বিবেক সহায়কে বরখাস্ত করা হয়।
বিবেক সহায় অতিরিক্ত ডিজিপি পদমর্যাদার অফিসার ছিলেন। তাকে বরখাস্ত করে জ্ঞানবন্ত সিংকে দেয়া হয় মমতার নিরাপত্তার দায়িত্ব। সংশ্লিষ্ট জেলাশাসক বিভু গোয়েল ও পুলিশ সুপার (এসপি) প্রবীণ কুমারকেও বদলি করেছে কমিশন।
ভোটের দায়িত্বে থাকেন রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের কর্মীরা। কিন্তু তাদের ওপর সব সময়ই নজরদারি থাকে কমিশনের। পান থেকে চুন খসলেই কড়া দাওয়াই। পশ্চিমবঙ্গের ভোটে ৫৫ জন পুলিশ ও ২০৯ জন সাধারণ পর্যবেক্ষক থাকবেন।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সাবেক চেয়ারম্যান বা মেয়রদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন মমতা। কিন্তু কমিশন সরকারি অফিসারদের সেই পদে নিয়োগ করেছে।
শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, সব রাজ্যেই নির্বাচন কমিশন এ ধরনের কড়া পদক্ষেপ নিতে অভ্যস্ত। ভারতের সাবেক মুখ্য নির্বাচন কমিশনার প্রয়াত টি এন শেষণের আমল থেকেই বেশ সক্রিয় কমিশন।
তবে এখন নির্বাচন কমিশনও বেশ চাপে থাকে। তাদের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিশেষ করে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল বহুদিন ধরেই কমিশনের সমালোচক। এবারও ৮ দফায় ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্তের বিরোধী তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটাও চাপের রাজনীতি। কমিশনকে চাপে রাখতে চান নেতারা। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশনকে মানতে বাধ্য সব দলই। মানছেনও নেতারাও।
বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন আজ ভোট পরিচালনায় অনেকটাই দক্ষ। তাই ভোটের ফলাফলে এতটা বদল ধরা পড়ে। ভারতীয় গণতন্ত্রের এই সুস্বাস্থ্যের জন্য নির্বাচন কমিশন অবশ্যই প্রশংসা পেতে পারে।
বিজেপি ও কংগ্রেসের মতো সর্বভারতীয় দল কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনো গুরুতর প্রশ্ন তোলেনি। অপছন্দের সিদ্ধান্ত নিয়ে মৃদু সমালোচনা হতেই পারে। কিন্তু আস্থা বিন্দুমাত্র টোল খায়নি আজও। বরং বেড়েছে।
তাই ২৭ মার্চ ভোট গ্রহণের পর ২ মে ভোট গণনা নিয়ে কারও কোনো আপত্তি নেই। রাজ্য পুলিশের বদলে কেন্দ্রীয় আধা সেনা ব্যবহার করে ইভিএম রাখার ঘরগুলোকে নিশ্ছিদ্র রাখার ঐতিহ্যই সকলকে আস্থাশীল করে তুলেছে।
পাঁচ রাজ্যের ভোটপর্ব আবার প্রমাণ করবে ভারতের নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ নয়। অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে তারা দক্ষ ও নিরপেক্ষ। ফের প্রমাণিত হবে। এটি আবারও প্রমাণিত হবে ২ মে।