একটি ধর্ষণ মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দেয়া শর্তে তোলপাড় সোশ্যাল মিডিয়া, দেশের নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলোতে। প্রতিবাদে সোচ্চার বলিউডের অনেকেই।
এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছিল মহারাষ্ট্র রাজ্য বিদ্যুৎ উৎপাদক সংস্থার কর্মচারী মোহিত সুভাষ চ্যাবনের বিরুদ্ধে। পসকো ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে শীর্ষ আদালতে। সোমবার সেই মামলার শুনানি চলাকালীন প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদে অভিযুক্তের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি বিয়ে করতে চাইলে আপনাকে সাহায্য করা হবে। তা না হলে আপনার চাকরি যাবে। জেলেও যাবেন। মেয়েটিকে আপনি হেনস্তা এবং ধর্ষণ করেছেন।’
এই শর্তের পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তিকে চার সপ্তাহের আগাম জামিনের সুযোগ দিতেও রাজি হয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। বেঞ্চের অন্য দুই বিচারপতি ছিলেন এ এস বোপান্না এবং ভি রামসুব্রহ্মনিয়াম।
আদালতের ওই শর্তের সমালোচনায় সরব বলিউড তারকা, নেট-নাগরিক, নারী অধিকার আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয়রা।
অভিনেত্রী তাপসী পান্নু মঙ্গলবার টুইটে প্রশ্ন করেন, ‘সেই নিগৃহীতাকে কেউ প্রশ্ন করেছে, সে তার ধর্ষককে বিয়ে করবে কিনা? এটা কোনো প্রশ্ন হলো? এটা একটা অপরাধের সমাধান?’
পান্নুর সুরেই সুর মেলাতে দেখা গিয়েছে গায়িকা সোনা মহাপাত্রকে। তিনি বলেছেন, ‘যথেষ্ট বিরক্তিকর একটা পর্যবেক্ষণ। বলিউড সিনেমায় দেখা গিয়েছে একজন ধর্ষক নিগৃহীতাকে বিয়ে করছে। দেশের সুপ্রিম কোর্ট কীভাবে এই শর্ত দিতে পারে?’
গোটা দেশের ৩ হাজারের বেশি বিশিষ্টজনের স্বাক্ষরিত এক খোলা চিঠিতে প্রধান বিচারপতিকে বলা হয়েছে, ‘আপনার বক্তব্য আদালতের কর্তৃত্বকে কলঙ্কিত ও খর্ব করেছে। দেশের প্রধান বিচারপতির পদে অবিচ্ছিন্ন উপস্থিতি ভারতের প্রতিটি মহিলাকে বিপন্ন করে তুলছে। আপনার বক্তব্য দেশের অল্পবয়সী মেয়েদের কাছে এই বার্তাই পাঠাচ্ছে যে, তাদের মর্যাদা এবং স্বাধিকারের কোনো মূল্য নেই। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির মতো একটি শীর্ষ পদ থেকে অন্যান্য আদালত, বিচারক, পুলিশ এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে এই বার্তাই পাঠানো হচ্ছে যে, ন্যায়বিচার ভারতের নারীদের সংবিধানস্বীকৃত অধিকার নয়।
‘আপনার বক্তব্য কেবল মেয়েদের এবং মহিলাদের আরও চুপ করে যাওয়ার দিকে পরিচালিত করবে, এমন একটি অবস্থা তৈরি করবে, যা ভাঙতে কয়েক দশক সময় লেগেছিল। আপনার মন্তব্য ধর্ষকদের এই বার্তাটি প্রেরণ করে যে, বিবাহকে ধর্ষণ করার লাইসেন্স হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে এবং এই লাইসেন্স প্রাপ্তির মাধ্যমে ধর্ষক তার কাজটিকে অপরাধমুক্ত, আইনীকরণ, নিজেকে অপরাধহীন করার সুযোগ পাবে।’
খোলা চিঠিতে বিতর্কিত বক্তব্য প্রত্যাহার, দেশের নারীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও অবিলম্বে প্রধান বিচরপতির পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন অবসরপ্রাপ্ত এডমিরাল এল রামদাস, অরুণা রায়, নিখিল দে, পামেলা ফিলিপোজ, আনন্দ সহায়, জন দয়াল, অপূর্বানন্দ, ফারাহ নকভি, নূপুর বসু, আয়েশা কিদোয়াই, অনামিকা হাকসার, আইনজীবী কমলা ভাসিন ও মহিলা নেত্রী মাইমুনা মোল্লা। এ ছাড়া প্রায় ৫০টি নারী গণসংগঠন এই খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছে ।
ধর্ষণে অভিযুক্ত হিসেবে জেল হলে তার চাকরি যাবে, তাই গ্রেপ্তার এড়াতে তাকে আগাম জামিন দেওয়া হোক, এই আবেদনে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্ত হয়েছিলেন মহারাষ্ট্র বিদ্যুৎ বণ্টন নিগমে কর্মরত ওই অভিযুক্ত। শুনানিতে প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদের বেঞ্চ তাকে প্রশ্ন করে, ‘আপনি কি মেয়েটিকে বিয়ে করবেন? তাহলে আমরা আপনার জামিন নিয়ে ভাবতে পারি। না করলে জেলেই যেতে হবে আপনাকে।’ অভিযুক্ত তরফের আইনজীবী আদালতকে জানান, তার মক্কেল বিবাহিত। যদিও সেই ঘটনার পর তার মক্কেল চেয়েছিলেন মেয়েটিকে বিয়ে করতে। কিন্তু মেয়েটি রাজি ছিলেন না। তাই তার মক্কেল বিয়ে করে নিয়েছেন। তাই এখন সরকারি কর্মী হিসেবে তার মক্কেল জেলে গেলে চাকরি খোয়াবেন।
অভিযুক্তের আইনজীবীর তরফে এই সওয়াল-জবাবের পর সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, ‘চাকরি খোয়ানোর বিষয়টা কুকর্ম করার আগে ভাবা উচিত ছিল। আপনার মক্কেল জানতেন তিনি সরকারি কর্মী।’
অভিযুক্ত তরফের আইনজীবী দাবি করেন, তার মক্কেলের বিরুদ্ধে এখনও চার্জ গঠন হয়নি।
সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ‘স্থানীয় কোর্টে সাধারণ জামিনের জন্য আবেদন করুন। আমরা গ্রেপ্তারিতে স্থগিতাদেশ দিচ্ছি।’
এই বলে অভিযুক্তের এক মাসের জন্য আগাম জামিন মঞ্জুর করেছে সুপ্রিম কোর্ট। এর আগে ৫ ফেব্রুয়ারি বোম্বে হাইকোর্ট তার আগাম জামিন খারিজ করে। জানুয়ারি মাসে স্থানীয় আদালত অভিযুক্তকে এই রক্ষাকবচ দিয়েছিল। হাইকোর্টের সেই রায়ের বিরোধিতা করেই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্ত হয়েছিলেন অভিযুক্ত।