বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মিয়ানমারে অভ্যুত্থান যে কারণে

  •    
  • ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ১২:০৫

মিয়ানমারে হঠাৎ অভ্যুত্থানের পেছনে রয়েছে অনেক কারণ। সবশেষ নির্বাচনে সেনা-সমর্থিত দল ইউএসডিপির ভরাডুবি, সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাংয়ের প্রেসিডেন্ট হওয়ার খায়েশ এবং সেনাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ার শঙ্কা ছিল এই অভ্যুত্থানের অন্যতম কারণ।

হঠাৎ সেনা-অভ্যুত্থানে টালমাটাল গণতন্ত্রের পথে থাকা মিয়ানমার। অং সান সু চিসহ এনএলডির নেতাদের গ্রেপ্তার করে কেন এই অভ্যুত্থান, সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাংয়ের উদ্দেশ্য কী, এখন কী হবে মিয়ানমারে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা

অভুত্থানের শুরুর গল্প

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক (এনএলডি) পার্টির বিরোধের শুরু গত ৮ নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে। ২০১১ সালে সামরিক শাসন অবসানের পর এদিন দ্বিতীয়বারের মতো গণতান্ত্রিক ভোট দেয় দেশটির জনগণ।

করোনার মহামারির মধ্যেও ভোটারদের উপস্থিতি ছিল ব্যাপক। মিয়ানমারের বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুনের ভোটকেন্দ্রগুলোতে উদ্দীপনা ছিল চোখে পড়ার মতো।

ওই দিন একজন নির্বাচনী কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘মানুষ ভোট নিয়ে উজ্জীবিত। রাজনৈতিক লড়াই থেকে তারা মুক্তি চায়; সত্যিকারের গণতন্ত্র চায়।’

নির্বাচনের এই আমেজ বিষাদে রূপ নিতে সময় লাগেনি। ভোটের কয়েক দিনের মধ্যেই মিয়ানমারের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রধান মিন অং হ্লাং আভাস দিতে থাকেন, নির্বাচনের এই ফল তারা না-ও মেনে নিতে পারেন।

নির্বাচনের ফল নিয়ে স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমকে হ্লাং জানান, সু চির সরকার ‘অগ্রহণযোগ্য কিছু ভুল’ করেছে। নির্বাচনের ফল নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন এক অবস্থায় রয়েছি, যেখানে আমাদের আরও সতর্ক হওয়া দরকার।’

ভোটে বিশাল জয় পায় সু চির এনএলডি। মোট ভোটের ৮০ শতাংশই পড়ে তাদের ব্যালট বক্সে। ২০১৫ সালের নির্বাচনের চেয়ে দলটির প্রতি ভোটারদের আস্থা আরও বাড়ে।

এই পরাজয় মানেনি ইউনিয়ন সোলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। তাদের অভিযোগে সমর্থন দেয় টাটমাডো নামে পরিচিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। কোনো প্রমাণ হাজির না করেই ইউএসডিপি জানায়, তাদের নিজস্ব তদন্তে দেখা গেছে, নির্বাচনে দেড় কোটি ভুয়া ভোট পড়েছে।

এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছিল ক্ষমতাসীন এনএলডি। সোমবার আইনসভায় নিম্নকক্ষে নবনির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে প্রথম অধিবেশন ডাকে তারা। কিন্তু এই অধিবেশনে না বসতে আহ্বান জানিয়ে আসছিল সেনাবাহিনী। এর মধ্যে গত বুধবার সংবিধান বাতিলের হুমকিও দেন সেনাপ্রধান হ্লাং।

তখনই ধারণা করা হচ্ছিল অভুত্থান হতে যাচ্ছে মিয়ানমারে। এ শঙ্কা নিয়ে সংবাদ ছাপায় বিশ্ব সংবাদমাধ্যম। সোমবার ভোরেই সত্যি হয় সেই শঙ্কা।

সেনাদের হাত থেকে জনগণের হাতে ক্ষমতা আসার ১০ বছর পার না হতেই ফের মিয়ানমারের ক্ষমতায় টাটমাডো। আটক করা হয়েছে সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট ও এনএলডির অন্তত ৪৫ জন নেতাকে।

অচল মিয়ানমার

অভুত্থানের পরপরই রাজধানী নেপিদোসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে সেনা মোতায়েন করা হয়। বিচ্ছিন্ন করা হয় টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ। বড় বড় শহরগুলোতে মোবাইল ইন্টারনেট ডেটা ও আরও কিছু সেবাও বিঘ্নিত হচ্ছে। পরিস্থিতি থমথমে।

সু চিদের গ্রেপ্তার করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মিয়ানমারে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সেনাবাহিনী।

জালিয়াতির অভিযোগ তুলে নভেম্বরের নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচন আয়োজনের কথাও বলছে সেনাবাহিনী। তবে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো সময় বেঁধে দেয়নি তারা। দেশ পরিচালনার ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয় সেনাপ্রধান অং হ্লাংয়ের হাতে।

প্রেসিডেন্ট হওয়ার খায়েশ হ্লাংয়ের

আইন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাইয়ে বয়স ৬৫ পূরণ হওয়ার পর সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হবে হ্লাংকে।

সিডনির নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের অধ্যাপক মেলিসা ক্রাচের মতে, অবসরের দ্বারপ্রান্তে থাকা এই জেনারেলের রয়েছে রাষ্ট্রপতি হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা। কিন্তু নভেম্বরের নির্বাচনে ইউএসডিপির ভরাডুবিতে হ্লাংয়ের উদ্দেশ্য ভেস্তে যাওয়ার জোরালো শঙ্কায় পড়ে।

২০০৮ সালে প্রণীত মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী, দেশটির আইনসভায় ১৬৬টি তথা ২৫ শতাংশ আসন টাটমাডো তথা সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ। মিন অং হ্লাংকে প্রেসিডেন্ট করতে দরকার আরও ছিল ১৬৭টি আসন।

কিন্তু সবশেষ নির্বাচনে বাকি ৪৯৮টি আসনের মধ্যে ইউএসডিপি পায় মাত্র ৩৩ আসন। আর এনএলডি পায় ৩৯৬ আসন, এতে নির্দিধায় নতুন সরকার গঠন করতে পারত গণতন্ত্রপন্থী দলটি।

সোমবার নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের নিয়ে পার্লামেন্টের অধিবেশনের ডাক দিয়েছিল এনএলডি। কিন্তু এদিন ভোরেই সব এলোমেলো করে দেয় সেনাবাহিনী।

ক্রাচ বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট অফিসের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে ফিরিয়ে আনতে তাদের আইনের বাইরে যাওয়াই লাগত।… এই এক বছর সময়ের মধ্যে তারা নতুন নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে। এতে ইউএসডিপি সফলভাবে প্রয়োজনীয়সংখ্যক আসন পেলে মিন অং হ্লাংয়ের প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্ভব হতে পারে।’

এর আগে সেনাবাহিনীর বাইরে মিন অং হ্লাং খুব কম পরিচিত মুখ ছিলেন না। দীর্ঘ ৪৯ বছরের সেনাশাসনে ইতি ঘটিয়ে ২০১১ সালে মিয়ানমারের যখন গণতন্ত্রের পথে উত্তরণ ঘটে, তখন সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হন তিনি।

২১০৫ সালে জোটবদ্ধভাবে এনএলডি জয় পেলে, জেনারেল হ্লাং নিজেকে ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখার জন্য পথ তৈরি করতে থাকেন। ২০১৬ সালে তার অবসর নেওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সে পথে হাঁটেননি তিনি।

এই সময়ে হ্লাং মনোযোগী হন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেনা থেকে নিজেকে পরিণত করেন পাবলিক ফিগারে। ধর্মীয় উপাসনালয় পরিদর্শন ও বিশিষ্টজনদের সঙ্গে বৈঠকসহ ফেসবুকে তার বিভিন্ন কার্যক্রম প্রচার করা হয় ফলাও করে।

২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর সহিংসতার সময় তার একটি ফেসবুক পেজে ফলোয়ারের সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ। ওই সহিংসতায় মিয়ানমারের রাজ্যটি থেকে প্রায় সাত লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। ওই ঘটনায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দুটি অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেয় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।

এ ছাড়া, ওই ঘটনায় উসকানি দেওয়ায় হ্লাংয়ের ওপর অবরোধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশ।

ব্যবসায়িক স্বার্থ

মিয়ানমারের অধিকার সুরক্ষাবিষয়ক একটি সংগঠন ‘জাস্টিস ফর মিয়ানমার’ বলছে, সোমবারের অভ্যুত্থান কেবল হ্লাংয়ের রাজনৈতিক প্রভাব রক্ষণের জন্যই নয়, তার সম্পদ রক্ষার জন্যও।

সংগঠনটি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এই জেনারেল নিজ স্বার্থে কমান্ডার-ইন-চিফের পদ ব্যবহার করেছেন। ক্ষমতা বাড়ানো এবং সুযোগসুবিধা নিতেই এই অভ্যুত্থান।’

সংগঠনটি জানিয়েছে, হ্লাং কমান্ডার-ইন-চিফ হওয়ার পর থেকে তার রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা নিয়ে লাভবান হয়েছে তার সন্তানেরা।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দুটি ব্যবসায়িক কনগ্লোমারেট-মিয়ানমার ইকোনমিক করপোরেশন (এমইসি) ও মিয়ানমার হল্ডিংস লিমিটেডের (এমইএইচএল) রত্ন আহরণ, কপার শিল্প, টেলিকম ও বস্ত্রশিল্প ইত্যাদি খাত নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এসবে প্রভাব রয়েছে হ্লাং ও তার পরিবারের।

এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে আগেই আহ্বান জানিয়ে রেখেছে জাতিসংঘ। তাদের মতে, এসব প্রতিষ্ঠানের আয় সেনাবাহিনীর হাত আরও শক্তিশালী করে। তাদের নিপীড়ন কার্যক্রমে আর্থিক রসদ জোগায়।

জাস্টিস ফর মিয়ানমারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত থাকলে এবং জবাবদিহি থাকলে তার (হ্লাং) ও তার পরিবার সম্পদ হারানোর শঙ্কায় পড়তে পারে।’

এই অভ্যুত্থান নিয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘বার্মা ক্যাম্পেইন’ বলেছে, ‘এটা মিন অং হ্লাং অভ্যুত্থান, সামরিক অভ্যুত্থান নয়। এটা করা হয়েছে তার পদ ও সম্পদ রক্ষার জন্য।’

জীবনমরণের প্রশ্ন

কিছু বিশ্লেষকের মতে, এই ক্যুর পেছনে রয়েছে সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ।

এ বিষয়ে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নটিংহ্যামের এশিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অনারারির গবেষণা সহযোগী গবেষক ব্রিজেট ওয়েলশের মতে, সবশেষ নির্বাচনে এনএলডির জয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অবস্থান ‘দুর্বল করে ফেলেছিল’।

তিনি বলছেন, সংবিধান সংশোধনীর বিষয়ে আইন পরিষদে সেনাবাহিনীর অনির্বাচিত কোটার ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু সবশেষ নির্বাচনের ফল মেনে নিলে আইন পরিবর্তন ইস্যুতে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংকটে পড়ে যেত।

তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর অবস্থান এবং মিয়ানমার নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা কঠিন হুমকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছিল।’

মিন অং হ্লাং সফলভাবে অভ্যুত্থান করতে পারলেও তিনি তার পদ ও সেনাবাহিনী তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে কি না এ নিয়ে প্রশ্নও তুলছেন পর্যবেক্ষকেরা।

ক্যুর পর পরই অং সান সু চির উদ্বৃতি দিয়ে এনএলডির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের জনগণ যেন সর্বত্র প্রতিবাদ গড়ে তোলে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সেনাবাহিনীর এই অবস্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে মিয়ানমারের উন্মুক্তমনা তরুণেরা।

বোয়ার গ্রুপ এশিয়ার বিশ্লেষক জে হ্যারিমান বলেন, ‘মিয়ানমারের বেশির ভাগ মানুষই এই অভ্যুত্থানে সমর্থন দেবে না।

‘বলা যায়, এটা কঠিন এক পরিস্থিতি। এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলো জীবনমরণের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮৮ সালে তারা যখন সেনাদের প্রতিহতে গিয়েছিল, তখন কয়েক হাজার মানুষ মারা পড়েছিল। যথাযথ প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগে বিষয়গুলো অবশ্যই অনেক মানুষের মাথায় কাজ করছে।’

এ বিভাগের আরো খবর