সারা জীবন নিজের ক্ষেতে কৃষিকাজ করেই কাটিয়েছেন পাঞ্জাবের নারী বালজিত কৌর। বছরের এ সময় তার মাঠেই থাকার কথা। কিন্তু এখন তিনি রাজধানী দিল্লির কাছে তিকরির রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন। উদ্দেশ্য সরকার যে তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন করেছে, সেগুলো বাতিল করা।
বালজিতের মতো আরও কয়েক হাজার নারী-পুরুষ শত শত মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কৃষি আইন বাতিলের দাবি জানাতে এসেছেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন চাষের ট্রাক্টর, তাঁবু আর রাস্তায় থাকার মতো কয়েক মাসের রসদ।
‘আমরা নিজেদের জমি রক্ষার জন্য বিক্ষোভ করছি। আমাদের প্রতিবাদ মোদির জারি করা কালো আইনের বিরুদ্ধে’, বলেন বালজিত।
এ বছরের সেপ্টেম্বরে পাস হয়েছে ভারতের তিনটি নতুন কৃষি আইন। চাষিদের আশঙ্কা, এই আইনগুলো কারণে কৃষি খাতে তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।
তাদের ভয়, আইনে ফসলের সর্বনিম্ন দামের কোনো বিধান না থাকায় বড় করপোরেশনগুলো ইচ্ছামতো ফসলের দাম নির্ধারণ করতে পারবে। তখন কৃষকেরা কী ফলাবেন আর কত দামে বেচবেন, তাও ঠিক করে দিতে পারবে কোম্পানিগুলো।
যদিও ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন সরকার বলছে, কৃষকদের ভালোর কথা চিন্তা করেই এমন আইন করা হয়েছে।
সিনঘু ও তিকরিত দিয়েই গেছে রাজধানী দিল্লিতে ঢোকার প্রধান দুইটি পথ। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতের কৃষিপ্রধান তিনটি রাজ্য পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশের লাখ লাখ কৃষক ওই দুই জায়গায় অবস্থান নিয়েছেন।
বিজেপি সরকার তাদের দিল্লিতে ঢুকতে দিতে না চাইলেও কৃষকদেরও সরার কোনো লক্ষণ নেই।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে কৃষক বিক্ষোভে পুরুষদের অংশগ্রহণ বেশি দেখা গেলেও নেপথ্যে বড় ভূমিকা রাখছেন নারীরা।
নতুন আইনগুলোর কারণে নারী কৃষকেরাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে মনে করছেন তারা।
মহিলা কিষাণ অধিকার মঞ্চ (মাকাম) নামে একটি সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, ভারতের কৃষিকাজের শতকরা ৭৫ ভাগ করেন নারীরা। যদিও তারা মাত্র ১২ শতাংশ ভূমির মালিক।
সংগঠনটির একজন সদস্য কবিতা কুরুগান্তি বলেন, ‘ভূমির মালিকানা না থাকায় নারী কৃষকদের অস্তিত্ব নেই বলে মনে হয়। কৃষি খাতে বড় ভূমিকা থাকলেও কৃষক হিসেবে তাদের স্বীকৃতি নেই। নতুন আইনের কারণে কৃষিতে বড় করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হলে তারা আরও বেশি শোষণের শিকার হবেন।’
নতুন আইনে ফসলের দাম নির্ধারণের বিধান না থাকায় এর প্রভাব পড়বে কৃষি শ্রমের ওপরও। এর ফলে কৃষিতে পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে নারীদের। ফসলের দাম কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই নারী কৃষি শ্রমিকদের মজুরিও কমে যাবে।
পাঞ্জাবের জলন্ধর থেকে ৪০০ মাইলের পথ পাড়ি দিয়ে তিকরি এসেছেন কুলিন্দার কৌর ও পারমিন্দার কৌর নামে দুই শিখ নারী। রাস্তার পাশে রাখা একটি ট্রাক্টরে অন্য নারীদের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন তারা। সেখানেই বসেই আল-জাজিরাকে সাক্ষাৎকার দেন তারা।
কুলিন্দার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, ‘যদি ফসলের দাম ঠিক না করা থাকে তাহলে আমরা ফসল বিক্রি করব কীভাবে? আমাদের সন্তানদের মুখেই বা কীভাবে খাবার তুলে দেবো?’
পারমিন্দার বলেন, ‘কোনো কাজই সহজ নয়। বেঁচে থাকার জন্য কাজ করতে হয়। কিন্তু কাজের পরও যদি খাবারের নিশ্চয়তা না জোটে তাহলে কাজ করে কী হবে?’
দুই জনই দাবি করেন বড় করপোরেশনগুলো কৃষকদের কাছে কেনা ফসল অন্তত চার গুণ বেশি দামে শহরে বিক্রি করে।
৬০ বছর বয়সী মুলকিত কৌর ৩০ বছর ধরে কৃষিকাজ করছেন। পাঞ্জাবের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই নারী দাবি করেন, কৃষিতে পুরুষদের চেয়েও বেশি পরিশ্রম করেন নারীরা। তার গ্রামের বেশির ভাগ নারীই কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত।
মুলকিতের আশঙ্কা, নতুন কৃষি আইন কার্যকর হলে তার আয় কমে যাবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের ফসলের দাম কমে গেলে আমরা কোথায় যাব?’
সৃষ্টিকর্তা তাদের পাশে থাকবেন, এই আশা নিয়েই এতটা পথ এসেছেন মুলকিত। পরের দিনই আবার নিজের গ্রামে ফিরে যাবেন তিনি। জানালেন, তার বদলে পরিবারের আরেক সদস্য এসে অংশ নেবে বিক্ষোভে।
পরিবারের দেখাশোনার পাশাপাশি কৃষিতে কাজ করেন নারীরা। চলমান বিক্ষোভে তারা তীব্র ঠান্ডার মধ্যেও পুরুষদের সঙ্গে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। এমন পরিবেশে তারা কষ্ট করে থাকছেন, যেখানে তাদের জন্য শৌচাগার নেই বললেই চলে।
ভারতে নারীদের কাছে কৃষি শুধু ভূমির মালিকানার প্রশ্ন নয়। তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎও এর সঙ্গে যুক্ত। পূর্বপুরুষের স্মৃতি ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি নিয়ে ভূমির মালিকানা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়।
বালজিত বলেন, ‘আমরা যদি প্রতিবাদ না জানাই, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের নিয়ে কী বলবে?’
তিনি বলেন, ‘এ কারণেই আমরা এখানে রাস্তায় বসে আছি। আমাদের নাতি-পুতিদের জন্য জমি বাঁচানোর জন্য।’
৫৮ বছর বয়সী জাসপাল কৌর তার স্বামীর সঙ্গে পাঞ্জাব থেকে তিকরিতে এসেছেন। তিনি মনে করেন, এই আইন নাতিপুতিদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিতে পারে। এর ফলে তাদের উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
জাসপাল বলেন, ‘আমাদের সন্তানরা কষ্টে থাকলে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই।’
২০১৯ সালে দারিদ্র্যের কারণে ও ঋণে জর্জরিত হয়ে ভারতে অন্তত ১০ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করেছিলেন।
জাসপাল কৌরের সঙ্গে আরও দুই জন নারী বসে ছিলেন। তাদের গায়ে জড়ানো ছিল হলুদ রঙের ওড়না। তারা জানালেন, ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখতেই এমন ওড়না পরেছেন তারা।
জাসপাল বলেন, ‘আমরা পুরুষের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে সামনে এগোব। কঠোর রাস্তাই আমাদের বেছে নিতে হবে।’
বিক্ষোভের জন্য কয়েক মাসের রসদ নিয়েই দিল্লির পথে রওনা দিয়েছিলেন কৃষকেরা। তাদের খাবার তৈরি হচ্ছে গণ রান্নাঘরে। সেখানে নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করছেন। বিক্ষোভে অংশ নেয়া যে কারো জন্য খাবার মিলছে বিনা মূল্যে।
নতুন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে স্লোগান দেয়ার পাশাপাশি পরস্পরের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিচ্ছেন তারা। বিক্ষোভের এমন তেজ ও সামাজিক বন্ধনের মুহূর্ত ক্যামেরায় ধারণ করছেন জাসি সাংহা।
৩৩ বছর বয়সী এই নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা নিজেকে ‘কৃষকদের সন্তান’ হিসেবে পরিচয় দিতেই ভালোবাসেন।
তিনি বলেন, ‘আমার বাবা একজন কৃষক নেতা ছিলেন। কৃষকদের জন্য তিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ কারণে আমিও এখানে এসেছি।’
তার ধারণ করা এক ভিডিওতে দেখা যায়, নারীরা একসঙ্গে গান গাইছেন। গানে গানে তারা বলছেন, ‘এই নারীরা এখানে জুলুমের বিরুদ্ধে লড়তে এসেছে।’
কৃষি আইন নিয়ে সরকার ও কৃষকদের মধ্যে আলোচনা চলছে। যদিও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি কোনো পক্ষই।
নারীরা বলছেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা রাস্তা ছাড়বেন না।
পারমিন্দার ও কুলিন্দার বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই এখানে আছি এবং শেষ পর্যন্ত থাকব। বাড়ি ফেরা নিয়ে ভাবছি না আমরা।’
জাসি বলেন, ‘ভূমি আমাদের মা। এখন ভারতের মায়েরা, বোনেরা, মেয়েরা এই বিক্ষোভের শিরদাঁড়া গড়ে তুলছেন।’