চলমান ডেঙ্গুর প্রকোপে জ্বর ও শরীর ব্যথা হলেই স্থানীয় ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক সংগ্রহ করে তা গ্রহণ করেন অনেকে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে জ্বর ও শরীরের ব্যথা প্রশমনে গ্রহণ করা অ্যান্টিবায়োটিক ডেঙ্গুর জটিলতা অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয় বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. মো. সাজেদ হোসাইন।
তিনি বলেন, ‘জ্বর হলেই স্থানীয় ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খাওয়ার সময় এখন আর নেই। কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ডেঙ্গুর জঠিলতা আরও বাড়িয়ে দেয়। ডেঙ্গুর একটি সাধারণ এবং খারাপ লক্ষণ হচ্ছে শরীরে ব্যথা। এক্ষেত্রে সবাই ব্যথার ওষুধ খায়। কিন্তু ডেঙ্গুর সময় ব্যথার ওষুধ মারাত্মক অ্যাফেক্ট (প্রভাব) ফেলে শরীরের ওপর।
‘ডেঙ্গুতে প্যারাসিটামল ব্যতীত অন্য কোনো ব্যথার ওষুধ খাওয়া যাবে না।’
মঙ্গলবার নগরীর ফতেয়াবাদ সিটি করপোরেশন ডিগ্রি কলেজ মিলনায়তনে ফার্স্ট এইড ও ডেঙ্গু নিয়ে সচেতনতামূলক এক সেমিনারে এসব কথা জানান তিনি৷
চলমান ডেঙ্গুর প্রকোপে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে সেমিনারটির আয়োজন করে স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সংগঠন কণিকা।
সেমিনারে মূখ্য আলোচক হিসেবে ডেঙ্গু ও প্রাথমিক চিকিৎসার নানা বিষয়ে আলোচনা করেন চিকিৎসক মো. সাজেদ হোসাইন।
ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণগুলো নিয়ে তিনি বলেন, ‘জ্বর হলে প্রথম ওষুধ হচ্ছে শরীরের ওজন অনুযায়ী চারবেলা করে প্যারাসিটামল। দ্বিতীয়ত তরল; ডেঙ্গুতে অনেক রোগী মারা যায় ডিহাইট্রেশনের (পানিশূন্যতা) জন্য। কিডনিকে কোনোভাবেই ডিহাইড্রেট করা যাবে না। বাসায় বসে স্যালাইন খাবেন। তৃতীয়ত, দুই থেকে তিন দিনেও জ্বর না কমলে অন্তত একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক দেখাবেন।’
সেমিনারে কথা বলছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. মো. সাজেদ হোসাইন। ছবি: নিউজবাংলা
তিনি বলেন, ‘অনেক চিকিৎসক আছেন অল্প টাকায় রোগী দেখেন। তাদের কাছে যাবেন, তাও কম্পাউন্ডারের (ফার্মেসি চিকিৎসক, এলএমএফ চিকিৎসক) কাছে যাবেন না। একান্তই আর্থিক সমস্যা থাকলে সরকারি হাসপাতালে ১০ টাকার টিকিট কেটে ডাক্তার দেখান।’
ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে কয়েকটি বিপজ্জনক লক্ষণের বিষয়ে জানিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, ‘জ্বরের পর শরীরের কোথাও যদি লাল লাল দাগ দেখা যায় বা শরীরের কোথাও রক্তক্ষরণ হয়, যেমন- দাঁতের মাড়িতে রক্তক্ষরণ হতে পারে, নাক দিয়ে পড়তে পারে, মুখ দিয়ে পড়তে পারে, মল-মূত্রসহ শরীরের যে কোনো স্থান দিয়ে ব্লাড যেতে পারে। ডেঙ্গুতে ব্লাড যাওয়াটা বিপজ্জনক সংকেত। ব্লাড গেলে তখনই আপনার হাসপাতালে যাওয়া দরকার; একজন চিকিৎসককে অবশ্যই দেখানো দরকার।
‘প্রচণ্ড জ্বরে দুর্বল হয়ে গেলে বুঝবেন আপনার পানি স্বল্পতা তৈরি হচ্ছে। তখনই দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, ডিহাইড্রেট হলে স্যালাইন দেয়া জরুরি। আরেকটা বিপজ্জনক সংকেত হলো- পেটে পানি চলে আসা, এটা হলেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
‘আরও একটা বিষয় আছে। অনেকেই হৃদরোগী আছেন, তারা ইকোস্প্রিন নামের একটি ওষুধ খান। কিন্তু ডেঙ্গুর সময় এ ওষুধটা খাওয়া যায় না। যদি খান, তাহলে রক্তক্ষরণ থামানো অনেক কষ্টকর হবে।’
ডেঙ্গু প্রতিরোধ উপায় সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা ডেঙ্গু নিয়ে দুটো বিষয়ে সচেতন থাকবেন। একটা হচ্ছে ডেঙ্গু যেন না হয় সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া, অন্যটি হলো ডেঙ্গু হলে কী করবেন?
‘ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটা ভ্যারিয়েন্ট আছে। একেকজনকে একটা ভ্যারিয়েন্ট আক্রমণ করছে। এতে দেখা যাচ্ছে- কারো শুধু জ্বরের মাধ্যমে সেরে যাচ্ছে, কারো প্লাটিলেট আর রক্তচাপ কমে, এমনকি কিডনি ড্যামেজ হয়ে মারা যাচ্ছে।
‘ডেঙ্গু মানে শুধু জ্বর নয়, ভ্যারিয়েন্ট অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন জটিলতা শরীরে দেখা যাবে।’
কলেজ প্রাঙ্গণে ফ্রী ব্লাড গ্রুপিং ক্যাম্পেইন করে কণিকা। ছবি: নিউজবাংলা
তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা বাসায় যেটা করতে পারেন, ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা কোন পানিতে বেশি জন্মায় সেটা জানতে হবে। স্বচ্ছ ও স্থির পানিতেই এডিস মশা বেশি জন্মায়। বারান্দায়, ফুলের টব বা জমে থাকা বৃষ্টির পানি থাকলে পানিটা ফেলে দেওয়া উচিৎ দ্রুত। সব জায়গাগুলো শুকনো রাখার চেষ্টা করতে হবে। শুধু তাই নয়, বাসার আশেপাশে আপনার প্রতিবেশীদেরও এটা বোঝাতে হবে।
‘আশেপাশে বেশি পানির স্থির কোনো জলাশয় থাকতে পারে, সেখানেও তো এডিস মশা জন্মাতে পারে৷ সেক্ষেত্রে কী করা যাবে? সেক্ষেত্রে আপনার জানালায় ছোট ছোট জাল আটকে দিতে পারেন, যেন এটা সবসময় থাকে। তাছাড়া ঘুমানোর সময় মশারি টাঙাতে হবে।’
কণিকার সভাপতি মো. কফিল উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. নঈমউদ্দীন হাসান তিবরিজী। এসময় কণিকার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সাইফুল্লাহ মুনির, কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম, কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং কণিকার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
যুব রেড ক্রিসেন্টের সহযোগিতায় সেমিনার ছাড়াও এইদিন কলেজ প্রাঙ্গণে রক্তদাতাদের সম্মাননা, ফ্রী ব্লাড গ্রুপিং ক্যাম্পেইন, বৃক্ষরোপন ও কুইজ প্রতিযোগিতার অয়োজন করে রক্তদাতা সংগঠন কণিকা।