সরকার করোনার টিকা প্রয়োগে মোট ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন। তিনি জানান, সরকারের ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা বলে গণমাধ্যমে যে তথ্য এসেছে, তিনি সেভাবে বলেননি বলে দাবি করেছেন।
করোনার টিকার পেছনে সরকার ২৩ হাজার কোটি টাকা বেশি ব্যয় দেখিয়েছে বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যে গবেষণা প্রকাশ করেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার সংবাদ সম্মেলনে আসেন মন্ত্রী।
সচিবালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘৪০ হাজার কোটি টাকার টিকা দেয়া হয়েছে বলেছি কিন্তু এটা সরকার খরচ করেছে এটা বলিনি। সরকার খরচ করেছে ২০ হাজার কোটি টাকা প্রায়। বাকিটা যে সাড়ে ৯ কোটি টিকা বিনা মূল্যে পেয়েছি সেটার দাম হিসাব করে বলেছি।’
গত ১২ এপ্রিল টিআইবি সংবাদ সম্মেলন করে গবেষণার ভিত্তিতে টিকার খরচের তথ্য পাওয়ার কথা জানায়।
‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় সুশাসন: অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে এই গবেষণা প্রকাশ করে সংস্থাটি জানায়, দেশে টিকা ক্রয় ও বিতরণে ১১ হাজার থেকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা হতে পারে।
এর পাশাপাশি টিকার ব্যবস্থাপনা খাতে খরচ হতে পারে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
এই হিসাব করে টিআইবি সেদিন বলে, সরকার যে ৪০ হাজার কোটি টাকা বলছে, প্রকৃত ব্যয় তার থেকে ২২ হাজার কোটি টাকা কম।
গত ১০ মার্চ রাজধানীর জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে বিশ্ব কিডনি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘টিকা ক্রয় ও টিকা দান কার্যক্রম মিলে এগুলোর পেছনে সব মিলিয়ে সরকারের প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহস করে এত বিশাল অঙ্কের টাকার কথা না ভেবে দেশের সবাইকে টিকার আওতায় এনেছেন বলেই দেশবাসী এখন করোনায় অনেকটাই স্বস্তিতে আছে। মানুষ আবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজে নামতে পারছে।’
অবশ্য টিআইবি তাদের হিসাবের পক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য বলতে পারেনি। পরে সংস্থাটির গবেষক মোহাম্মদ জুলকারনাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা একটি এস্টিমেশন (আনুমানিক হিসাব) করেছি।’
তিনি বলেন, ‘টিকা কেনার সময় বিভিন্ন সোর্স থেকে টিকার যে দাম জানানো হয়েছে, সেটা নেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক বা সেকেন্ডারি সোর্সের মাধ্যমে টিকা ক্রয়ে যে তথ্য পেয়েছি সেই তথ্যের ভিত্তিতে আমার এস্টিমেশন তথ্য প্রকাশ করেছি।’
চীনের সিনোফার্ম থেকে দেশে বড় সংখ্যক টিকা আসছে, এই টিকার দাম প্রকাশ করেনি সরকার তাহলে আপনারা যে তথ্য প্রকাশ করেছেন সেই তথ্যের ভিত্তি কী- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ের সরকারের প্রকাশিত তথ্য এবং আমাদের প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি সোর্সের মাধ্যমে তথ্যে থেকে নেয়া হয়েছে। তবে এটা আমাদের এস্টিমেশন।’
অনুমানের ভিত্তিতে এত বড় অনিয়মের অভিযোগ আনা এই গবেষক বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ করছি, আসলে কী কী বাবদ কত টাকা খরচ হয়েছে সেটা জনসম্মুখে প্রকাশ করলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। তবে এটা যে অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছে, বিষয়টা এমন নয়।’
টিআইবির সংবাদ সম্মেলনের পর টিকার ব্যয় নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে আসার পরিকল্পনার কথা জানায় মন্ত্রণালয়। সে সময় মন্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় তাৎক্ষণিক জবাব আসেনি সরকারের পক্ষ থেকে।
তার ১০ মার্চ দেয়া বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে মন্ত্রী তার এই সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তারা মোট সাড়ে নয় কোটি টিকা পেয়েছেন উপহার হিসেবে। সেদিন এই উপহারের টিকার দাম ধরে বক্তব্য রেখেছেন।
তবে উপহারের টিকার দাম কেন উল্লেখ করতে হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা মন্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
তিনি জানান, টিকা কিনতে ব্যয় হয়েছে মোট ১৭ হাজার কোটি টাকা। আর সেই টিকা পরিবহন, বিতরণ ও প্রয়োগে ব্যয় হয়েছে বাকি তিন হাজার কোটি টাকা।’
কোন টিকা কিনতে কত খরচ হয়েছে, সেটি এই সংবাদ সম্মেলনেও বলেননি মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘প্রথমে ভারতের কাছ থেকে টিকা নেয়া হয়েছে, পরে চীনের কাছ থেকে নিয়েছি। সেটা ভারত ও কোভেক্সের টিকার দামের কাছাকাছি। কোভেক্স থেকে ১০ কোটি ডোজ কিনেছি, এটা ডব্লিউএইচওতে গেলে দাম জানতে পারবেন। সবচেয়ে বেশি টিকা বিনা মূল্যে পেয়েছি।’
টিআইবির প্রতিবেদন বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘যারা তথ্য দিয়েছে তারা কোত্থেকে তথ্য নিয়েছে আমার জানা নেই। কারণ টিকা কতে দিয়ে কিনেছি, সেটি তো রেকর্ডে নেই। কাজেই কেউ যদি ভুল তথ্য দেয় সেটি আমরা মেনে নিতে পারব না।
‘আমরা অবশ্যই এটা প্রত্যাখ্যান করি। একটা সংস্থা তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। যেহেতু এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, তাই সব সময় আইনি ব্যবস্থার পক্ষে না। তবে প্রয়োজন হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে পারে।’
করোনার টিকা যখন ভারতীয় কোম্পানি সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা হয়, তখন সরকার তার ব্যয় প্রকাশ করেছিল। ৪ ডলার ভিত্তিমূল্য ধরে টিকা কেনা হয়। তবে এতে উল্লেখ ছিল, ভারত সরকার যে দরে টিকা কিনবে, সেটি যদি ৪ ডলারের কম হয়, তাহলে বাংলাদেশ সেই দামেই টিকা পাবে। আর যদি ভারত সরকার ৪ ডলারের বেশিতে টিকা কেনে, তাহলে বাংলাদেশ ৪ ডলারই দেবে। পরে এই কোম্পানিটি যখন টিকা সরবরাহে সফল হয়নি, তখন সরকার চুক্তি করে চীনের সঙ্গে।
প্রথমে জানানো হয়, চীনের টিকার দাম পড়ে সিরামের টিকার দ্বিগুণেরও বেশি, ১০ ডলার। তবে বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর চীন টিকা চুক্তি বাতিলের হুমকি দেয়। কারণ, তারা অন্যান্য দেশে আরও বেশি দামে টিকা বিক্রি করেছে, বাংলাদেশকে তারা বিশেষ ছাড় দেয়। পরে চীনের শর্ত মেনেই টিকা কেনায় কত টাকা ব্যয়- এ বিষয়ে আর কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
অবশ্য চীনের কাছ থেকে টিকা আসার পর বিশ্বজুড়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জোট কোভ্যাক্স থেকে ভর্তুকি মূল্যে সরকার কোটি কোটি টিকা পেয়েছে। তবে টিকাপ্রতি ব্যয় কত, সেটি আর জানানো হয়নি।
চীনের কাছ থেকে টিকা কেনার সময় দাম ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর গোপনীয়তা রক্ষা করতে না পারায় সে সময় সরকারের সমালোচনাও হয়েছে।
মন্ত্রী জানান, এরই মধ্যে প্রায় ১৩ কোটি প্রথম ডোজ, ১১ কোটি ৬০ লাখ দ্বিতীয় ডোজ এবং প্রায় ১ কোটি বুস্টার জোড দিয়েছে সরকার। মোট জনগোষ্ঠীর ৭৫ শতাংশকে প্রথম ডোজ, ৬৮ শতাংশকে দ্বিতীয় আর বুস্টার ডোজ দেয়া হয়েছে ৭ শতাংশকে।
তিনি বলেন, ‘টিকার সাফল্যের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। এ কারণে নানা আলোচনা হয়। এসব আলোচনায় সঠিক তথ্য সব সময় আসে না। টিআইবি রিপোর্ট দিয়েছে, বেশ কিছু তথ্য আছে যেগুলো সত্য নয়। টেলিফোনের মাধ্যমে তথ্য নেয়া হয়েছে। সার্ভে করা হয়েছে মাত্র ১৮০০ মানুষের মধ্যে। এত ছোট পরিসরে সার্ভে করায় সঠিক তথ্য উঠে আসেনি। এটার সাইজ এত ছোট যে আমরা এটাকে সঠিক বলে ধরে নিতে পারি না।’
টিআইবির প্রতিবেদনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘ষাটোর্ধ্বরা টিকা পাননি এ তথ্য ঠিক নয়। দেশে কেউ বাকি নেই। যারা পাননি তারা নিজের ইচ্ছায় নেননি।
‘আমরা কমিউনিটি ক্লিনিক, ভাসমান মানুষের কাছেও টিকা নিয়ে গেছি। টিকা নিতে ঘুষ দিতে হয়েছে এ তথ্যও মেনে নিতে পারছি না। মহিলা ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা বুথ করা হয়েছিল।’